শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০২৪

সবাই তো মুগ্ধ এর কাহিনি শুনছেন আজ না হয় ফারহান ফাইয়াজের কাহিনি শুনুন

আপনারা সবাই তো মুগ্ধ এর কাহিনি শুনছেন আজ না হয় ফারহান ফাইয়াজের কাহিনি শুনুন। কারন ওর জীবনের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীনতা। পুরো লিখাটা পড়বেন আশা করি। 

আমার কোচিং যখন শুরু করি তখন আমার ৪ জন শিক্ষার্থীর ছিলো। জিদান, উৎসব, আদ্রিতা আরেকটা মেয়ে। ওরা তখন এস এস সি পরীক্ষা দিবে।আস্তে আস্তে জিদান উৎসব এর সাথে ভাইয়ের মতো সম্পর্ক হয়ে গেলো। একদিন ওদের সাথে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়ার সময় ব্যাগ ঘাড়ে একটি ছেলে আসলো। তখন কিন্তু সন্ধ্যা। ছেলেটা জ্বলতেছিলো। নুরানী চেহারা।  আমি মনে মনে ভাবলাম এত্ত সুন্দর দেখতেও ছেলে হয়? ছেলেটা আর কেউ নয় আমার ফারহান। 

আপনারা যাকে ফারহান নামে চিনেন আমি তাকে ধলা বলে ডাকতাম কেননা ও এত্ত ফর্সা ছিলো যে ওকে ধলা বলে ডাকতাম। আমাকে ফোন করে বলতো ভাই আমি ফারহান বলছি কিন্তু যত্তখন না ধলা বলতো আমি শুনতাম না। যাই হোক ওইদিন সন্ধ্যায় ও আমাকে বলতেছে ভাইয়া আমার কেমিস্ট্রিতে দুর্বল এবং বায়োলজি আমি একদম কিছুই পড়া হয় নাই।। আমি তারপর ওকে কিছু টিপস দিলাম। পড়ের দিন দেখি বান্দা আমার কোচিং এ হাজির। আমি যতটুকু শুনছিলাম ফারহান কোরআনের হাফেয অথবা সুন্দর কোরআন তেলোয়াত করতো আমি সঠিক মনে নাই। কিন্তু যেইদিন আমার কোচিং আসলো সেইদিন আমি বুঝলাম যে ও শুধু দেখতে সুন্দর বিষয়টা এমন না ওর মেধা তার থেকেও প্রখর। কোন জিনিস ওকে বুঝিয়ে দিলে ও সেটা দুই বার পড়া লাগতো না অনেক দিন ধরে মনে রাখতে পারতো।



তখন পরীক্ষার আছে আর মাত্র ২ মাস বাকি। ও বুঝতে চাইতো কিন্তু ওকে যেসকল স্যারেরা পড়িয়েছে তারা সবাই মুখস্থ করাতো তাই ওর প্রিপারেশন ভালো ছিলো না।।  এবার আমি ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে একা বসতাম।।আমার কানে এখনো বাজে ও আমাকে বলতো ভাই তুমি যেইভাবে জিদানকে বানাইছো আমাকে ওমন করে বানাই দাও। ওর অবস্থা এত্তটাই খারাপ ছিলো যে পাস করতো কিনা সন্দেহ  ছিলো। আমি ওকে একা একা পড়িয়ে ঠিক করছি।। এমন অনেক সময় হইছে রাত ৩ টা আমাকে ফোন করে বলছে ভাই পড়তে না মন চাচ্ছে না।।  একটু মোটিভেশন দাও। আমার সাথে যেদিন লাস্ট দেখা সেদিন ২ ভাই হাটতে হাটতে কত কথা। ভাই ইন্টারে ফাকি মারা যাবে না এই করা যাবে না।। কত্ত কথা।। কিছু হলেই আমাকে বলতো ভাই কি করবো? এটা করা ঠিক হবে কি?  কোন মেয়ে ওকে প্রোপোজ করে ভয়েস দিলেও সেটা আমাকে পাটাই বলতো " বলো ভাই কি করবো? আমার পাগলটা। 

তারপর এস এস সি পরীক্ষা দিলো। কেমিস্ট্রি পরীক্ষার আগের ১ দিন ছুটি ছিলো। ওর যেহেতু অনেক গ্যাপ ছিলো ও ভয়তে ১ দিন গ্যাপে একটা লাইনও পড়ে নাই।।এবার আসছে আমার কাছে পরীক্ষার আগের দিন।। ওই দিন আমি এবং ফারহান, জিদান এদের নিয়ে রাত ১১ টা পর্যন্ত কোচিং এ পড়াইছি।

যেইদিন পরীক্ষা শেষ তারপরদিন সকালে উঠেই বান্দাগূলো আমার কোচিং এ হাজির। কারন কি তাদের টাকা দিতে হবে। ওই দিনের কথা তো আমি ভুলবোই না। ওইদিন ও যা করছে এবং আমার পঞ্চপান্ডবগুলা।আল্লাহ এখনো হাসি পায়।

তারপর যেদিন রেজাল্ট দিবে তার আগের দিন রাত ১২ টা পর্যন্ত আমাকে কোচিং এ আটকাই রাখছে। কারন কি? তার ভয় লাগতেছে। সে কি প্লাস পাবে নাকি।। আমার কোচিং সেই বিকাল থেকে এসে বসে আছে। আমি অন্য ব্যাচের ক্লাস নিচ্ছি আর সে মাঝে মাঝে এসেই বলতেছে ভাই প্লাস কি পাবো? ও ভাই কও না।।তুমি যা কও তা তো হয়।। ওর পেশার দেখে আমি ওকে চায়ের দোকানে নিয়ে গেলাম।।গিয়া চা, স্প্রাইট খাইয়ালাম।। আইস্ক্রিম খাওয়াইলাম।। এবং কিছু টাকা দিয়ে বললাম আরো খা।। পরে অনেক রাতে সে আমাকে ছাড়লো। 

রেজাল্ট এর দিন সবাই আগে মা বাবাকে জানায়।।আর ফারহান সবাই আমাকে ফোন করে জানিয়েছে।।দুপুর খুসির ঠেলাই আমাকে জরাই ধরে কি যে করলো আল্লাহ। তারপর বিকালে ওর খালাকে নিয়ে আসলো মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য।।



এরপর শুরু হলো আসল যন্ত্রনা। ভাই আমার গ্যাপ পুরোন করে দাও। আমি এসএসসি তে যা করছি  ইন্টারে তা করবো না।। নটোরডামে পরীক্ষার জন্য কিছুটা প্রিপারেশন নিলো।।পরে আবার সেই রেসিডেন্সিয়াল এ ভর্তি হলো। 

ফারহানের ইচ্ছা ছিলো দেশের বাইরে চলে যাওয়া।।কিন্তু আমি ওকে বলছিলাম যে অনন্ত ইন্টার দিয়ে এডমিশন দিয়ে যেনো বিদেশ যাই। ও আমার কথাই বললো ঠিক আছে ভাই আমি এডমিশন দিবো বুয়েটের জন্য কিন্তু চান্স পাইলেও কিন্তু বিদেশ যাবো।ওর আগে বায়োলজি ভালো লাগতো না কিন্তু শুধু আমার কাছে পড়ার জন্য বায়োলজি ইন্টারে রেখে দিলো। ও ইন্টারে এত্ত মনোযোগী ছিলো যে বলার মতো না।।আমি আমার এই পঞ্জ পান্ডবকে বলছিলাম যে ওদের মধ্যে কেউ বুয়েটে চান্স পেলে আমার R15  বাইক তার।। ফারহান আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো যে ও চান্স পেয়ে দেখাবে।। আপনারা যে পোস্টটা ভাইরাল হতে দেখেছেন যে ওর বইয়ের টেবিলে ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স ছিলো? এইটা ওই কারনেই।ওর জিদ অনেক ছিলো।। যা বলতো তাই করবো

ইন্টারে ক্লাসের সময় মনোযোগ দিয়ে ও ক্লাস করতো।।ওর হাসি আল্লাহ এত্তসুন্দর হাসি আসলেই ভুলার মতো না।। দিনের মধ্যে বাসাই থাকতো কম৷ আমার কোচিং এবং জুয়েলের চার দোকানে থাকতো বেশি।। আমার কাছে ২ মাস পরার পর ওর বাবা বাসা চেঞ্জ করে বেইলি রোডে নিয়ে যাই।। সেই বেইলি রোড থেকে ও আমার কাছে পড়তে আসতো  ২ থেকে ৩ ঘন্টা জ্যাম ঠেলে।।আমি বলতাম এত্ত কষ্ট করে কেন আসিস?? ও বলতো ভাই তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না।।হাইরে আমার ভাই

আমি কি করে ভুলবো রে আমার ভাই।।? আমাকে বলতো 

" ভাই বেইলি রোডে তুমি একটা শাখা দাও। আমি ছেলে  পেলে ম্যানেজ করে দিবো।।" তাও সে আমার কাছে পড়বেই।।ওরা আমার স্টুডেন্ট না। ওরা আমার ভাই। তারপর ওর কষ্ট দেখে আমি বললাম সব বই শেষ কর তারপর পরিক্ষার কিছুদিন আগে আসিস আমি বায়োলজি ক্লিয়ার করে দিবো। শেষে ৬ মাস মতো আর আমার কাছে পড়তে পারে নাই।। কিন্তু সে আমাকে দেখতে মাঝে মাঝে আসতোই। 

আমি যেইদিন পোস্ট দিলাম যে যারা আন্দোলনে অংশ নিবে তাদের জন্য বায়োলজি সিকারস এর পক্ষ থেকে সকল কোর্স ফ্রি।। ( যদিও পোস্টটি রিমুভ করে দেওয়া হয়েছে)।  সেখানে ফারহান আমাকে লিখছে "আগষ্টে আসছি কিন্তু ভাই 

ফিস কিন্তু মাফ" 

যেদিন মারা গেলো সেদিন আমাকে আমার আরেক শিক্ষার্থী ফোন করে বলতেছে ভাই ফারহান নামের কেউ কি তোমার কাছে পড়তো? ও নাকি মারা গেছে? আমি ঘুমাই ছিলাম।।আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়ছি পরে জিদানকে ফোন দিলে  জিদান আমাকে বলে " আবিদ ভাই আপনার ধলা আর নাই"

পরে ফেসবুকে পোস্ট দেখি আমার ভাইকে গুলি করা হয়েছে।। ওকে রিক্সা করে নিয়ে যাচ্ছে কেউ

আন্দোলনে নাকি ও সবার সামনে ছিলো। যখন সবাই পিছিয়ে যাচ্ছিলো তখন আমার আরে শিক্ষার্থী সেও রেসিডেন্সিয়াল এর ইংলিশ ভার্শনের তার থেকে লাঠি নিয়ে ফারহান সবার আগে চলে যায়। তার গুলি এসে নাকি ফারহানের লাগে। ফারহানের ঠিক কপালের মধ্যে একটা গুলি লাগে এবং ২ টি বুকে লাগে। হাসপাতালে নিলে জানায় যে ও মারা গেছে। আমার চোখ দিয়ে কখনো পানি পরে না যারা আমাকে চিনে তারা জানে যে আমি সারাক্ষন হাসি কিন্তু ও মারা গেলে আমার কান্না থামছিলোই না ওর লাশ যখন  দেখি তখনও ওর মুখে হাসি ছিলো।।হাসতেছিলো আমার ভাই।।

ফারানের সাথে আমার এত্ত মেমোরি যা বললে শেষ হবে না।।শুধু এইটুকু বলবো আপনারা জানেনই না কত বড় একটা মেধা হারিয়ে ফেলেছেন।। ওর মতো ছেলে খুব কমই ছিলো।।সেইদিনও একটা ১০ এর ছেলে আমাকে বলছিলো ভাই ফারহান ভাই ফেস্টে তার খাবারটা নিজে না খেয়ে আমাকে দিছিলো আমি পাইছিলাম না বলে।। আমরা একটা সোনা হারিয়ে ফেলছি।।

ফারহান ভাই আমার এই বাংলাদেশের সকল শিক্ষার্থী, সকল জনগন৷ সবাই ভুলে গেলেও তোর আবিদ ভাই তোকে ভুলবে না।। তোর আবিদ ভাই সারা জীবন তোকে মনে রাখবে।। তোর রক্তের বিনিময় যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি সেটি রক্ষার্থে কাজ করবে।। ওপারে ভালো থাকিস ভাই।। আল্লাহ তোকে জান্নাতুল ফেরদৌসের নসীব করুক। সকলে আমার ভাইকে মনে রেখেন ভুলে যাইয়েন না।। ওর জন্য দোয়া করেন।

(আবিদ ভাই, সংগৃহীত ফেসবুক থেকে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন