‘মা, আমি আর হসপিটালে থাকতে চাই না। আমি খুব ক্লান্ত। এই কয়টা দিন আমি আমার জীবনটা নিজের মত করে উপভোগ করতে চায়। প্লিজ, আমাকে নিয়ে চলো’।
‘নাদিয়া, তুমি ভাল করেই জানো তুমি এখানে কেন আছো। তাহলে কেন নিজেকে বিপদে ফেলতে চাচ্ছো’?
‘আমি কিছু জানিনা। আমি শুধু জানি আমার হাতে আর অল্প কিছুদিন সময়। তাহলে বাকি সময়টুকু কেন আমি আনন্দে কাটাবো না’।
তখনই নার্স খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো। বিরক্তিকর একই খাবার দেখে নাদিয়া সজোরে দরজা খুলে বাইরে চলে আসলো। অনেক কষ্ট হচ্ছে তার। বুক ফেটে কান্না আসছে। নাদিয়া হসপিটালের ছাদে যেয়ে দাড়ালো যেন কেউ দেখতে না পায়।
ছাদে একটা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছে সে খুব তৃপ্তি নিয়ে পিজ্জা খাচ্ছে। কিন্তু ছেলেটা হসপিটালের পোশাক পরে আছে তার মানে সে ও রোগী। পিছনে না তকিয়েই ছেলেটা নাদিয়ার উপস্থিতি টের পেল এবং বলল, ‘এখন কান্না থামাও! এসো পিজ্জা খাও। আমি জানি তুমি হসপিটালের খাবার খেতে খেতে ক্লান্ত’।
আরও: একটা ডিভোর্সি মেয়ের কষ্ট
নাদিয়া সামনে এগিয়ে গেল। এক টুকরা পিজ্জা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কিভাবে জানলে আমি হসপিটালের খাবার পছন্দ করিনা’।
-‘কারন আমার মনে হয় কেউই এই খাবার পছন্দ করেনা’।
-‘তা ঠিক’।
নাদিয়া তার সাথে পরিচিত হতে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বারিয়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যালো, আমি নাদিয়া’।
নীল তার সাথে শেকহ্যান্ড করে বলল, ‘খুব সুন্দর নাম। কিন্তু ওরকম সুন্দর হাসি তোমার চেহারায় দেখা যাচ্ছেনা।
ওহ সরি! আমার নামই তো বলা হয়নি। আমি নীল’।
‘তুমি আমার চেহারায় হাসি দেখতে পাচ্ছো না কারন আমি ফুসফুস ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছি। আমি আর মাত্র অল্প কিছুদিন বাচবো এই পৃথিবীতে’।
‘তুমি আর অল্প কিছুদিন বাচবে তাই হাঁসতে পাবে না এটা খুবই হাস্যকর যুক্তি। আমিও লিউকোমিয়াই আক্রান্ত। আর অল্প কিছুদিন বাচবো। তা সত্ত্বেও আমি যদি হাঁসতে পারি তুমিও পারবে’।
নাদিয়া মনে মনে ভাবছে তাদের মধ্যে কত পার্থক্য, শুধুমাত্র একটা বিষয় বাদে সেটা হচ্ছে দুজনেই খুব শীঘ্রই মারা যাবে। কিন্তু নাদিয়া তার জীবন থেকে সব আশা হারিয়ে ফেলেছে সাথে মুখের হাসিও। অথচ ওদিকে নীল কত হাসিখুশি আর পুরোদমে জীবনটা উপোভগ করছে।
কিন্তু আসল সত্যটা হচ্ছে নীল তার জীবনের শেষ লড়াই টুকু করছে একা। নীল হচ্ছে ধনী বাবা মায়ের সন্তান যারা কিনা এতটাই ব্যস্ত থাকে যে শুধুমাত্র টাকা পাঠিয়েই তাদের দায়িত্ত পালন করে। আসলে নীল ভিতরে ভিতরে ভীষন নিঃসঙ্গ একটা মানুষ কিন্তু তা প্রকাশ করেনা।
সুতরাং তাঁরা দুজনেই আসলে অসম্পুর্ন। একজন জীবনের শেষ কটা দিন আনন্দ ছাড়াই কাটিয়ে মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে, আর আরেকজন তার ভিতরের একাকী সত্ত্বাটার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলেছে সুখে থাকার অভিনয় করে।
‘নাদিয়া, তোমাকে আমার পিজ্জার ভাগ দিয়েছি, এখনতো একটু হাসো’, নীল বলল। নাদিয়া হাসতে হাঁসতে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ নীল, আমাকে পিজ্জার ভাগ দেয়ার জন্য আর আমার মন ভাল করে দেয়ার জন্য’।
‘ওয়াও! কী সুন্দর হাসি! এই হাসির জন্য তো আমি মরতেও পারি। আমি তোমার জন্য যে কোন কিছু করতে পারব, স্পেশালি তোমার এই হাসি দেখার জন্য’।
নীল আসলে নাদিয়ার প্রেমে পরেছে যখন সে নাদিয়াকে প্রথম দেখেছিল ওর মায়ের সাথে রাগারাগি করার সময়। সে তখনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল যেভাবেই হোক নাদিয়ার মন ভাল করবে, তাকে হাসিখুসি রাখবে।
(দুজনেই প্রায় বিশের কাছাকাছি বয়সের ছিল, যার একজন হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়ের পরম যত্নে বেড়ে উঠা আর আরেকজন ছিল ধনী পরিবারের অযত্ন অবহেলায় থাকা সন্তান।)
নীলের কথা শুনে নাদিয়া একটু লজ্জা পেল। নীল এই সুযোগটা লুফে নিয়ে তাকে ফ্লার্ট করতে লাগলো, ‘তোমার মনটা আরেকটু ভাল করে দেই, তাহলে এর থেকেও চওড়া হাসি দেখতে পাবো’ বলেই নীল দুটো কাগজ নিয়ে একটা নাদিয়াকে দিয়ে বলল, ‘এখানে তোমার সব ইচ্ছে গুলো লিখ যেগুলো তুমি মারা যাবার আগে পূরণ করতে চাও’।
দুজনেই তাদের ইচ্ছেগুলো লিখতে শুরু করল।
নাদিয়ার ইচ্ছে গুলো ছিল:
১। বাইক চালানো।
২। মধ্য রাতে সমুদ্র সৈকতে হাটা।
৩। খোলা ছাদে আকাশের তাঁরার নিচে ঘুমানো।
৪। ক্লাবে সারা রাত পার্টি করা।
৫। ভালবাসার মানুষের সাথে ধুমধাম করে বিয়ে করা।
নীলের ইচ্ছে গুলো ছিল:
১। মারা যাবার আগে বাবা মায়ের সাথে একবার দেখা করা।
২। তাদের জরিয়ে ধরতে চাই।
৩। তাদের সাথে মন খুলে অনেক অনেক কথা বলতে চাই।
৪। তাদের সামনে কাঁন্না করতে চাই।
৫। কেয়ারিং আর কিউট একটা গার্লফ্রেন্ড চাই।
অসম্পূর্ণ পূর্ণ ভালবাসা (নাদিয়া ও নীল) |
নাদিয়া আর নীল লিস্ট দুটো একে অন্যের সাথে পরিবর্তন করল। নীল সিদ্ধান্ত নিল নাদিয়ার সব ইচ্ছেগুলো পূরণ করবে।
নীলের ইচ্ছেগুলো দেখে নাদিয়া বুঝতে পারলো নীল শুধু ভাল থাকার অভিনয় করে, আসলে ভিতর থেকে নীল সবসময় তার বাবা মাকে কাছে না পাওয়ার কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে চলে। নাদিয়া ঠিক করল নীলের জন্য সে কিছু করবে যেন সত্যিকার অর্থেই নীল সুখি হয় কারন নাদিয়াও নীলকে ভালবেসে ফেলেছিল। কিন্তু কেউই তাদের মনের কথা জানত না।
নীল রাতে নাদিয়াকে হসপিটালের গেটের সামনে দেখা করতে বলল। ততক্ষনে নাদিয়া হসপিটালের রিসেপসনিস্ট এর কাছ থেকে নীলের বাবা মার সম্পর্কে খোজ নিল। রিসেপসনিস্ট জানালো প্রথম দিন থেকেই নীল এখানে একা আছে। নাদিয়া সেখান হতে নীলের মায়ের ফোন নাম্বার নিয়ে ওর মায়ের সাথে কথা বলল।
নাদিয়া নীলের মাকে বুঝালো যে নীল তাদের সন্তান, তার সাথে যাই হোক না কেন। এখন নীলের তাদেরকে পাশে প্রয়োজন, তাদের যত্ন, ভালবাসা, সময় প্রয়োজন। নীলের মা তার ভুল বুঝতে পারলো এবং খুব শিঘ্রই নীলের সাথে দেখা করবে বলে নাদিয়াকে আশ্বস্ত করল। সাথে নাদিয়া এটাও বলল যে, নাদিয়া তাদের এখানে আসতে বলেছে এটা যেন নীলকে না জানাই। নীলের জন্য এটা সারপ্রাইজ।
রাতে নাদিয়া রুম হতে চুপি চুপি বের হয়ে আসলো। নীল বাইরে অপেক্ষা করছে তার জন্য। নীল তার হাতে কিছু পোশাক দিয়ে হসপিটালের পোশাক চেঞ্জ করে আসতে বলল। নাদিয়া পোশাক চেঞ্জ করে আসলো। নাদিয়াকে দেখতে খুব আকর্ষনীয় লাগছে।
‘কি ব্যাপার! আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে দেখতে কি খুব খারাপ লাগছে’? নাদিয়া জিজ্ঞেস করল।
নাদিয়ার কথা শুনে নীল তাকানো বন্ধ করে বলল, ‘তোমাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে’।
‘ওহ আচ্ছা। ধন্যবাদ। যদিও ড্রেসটা তোমারই পছন্দের’।
আমি জানি। কিন্তু আমি এটা জানতাম না যে তোমার উপর পোশাকটা এত সুন্দর দেখাবে।
নাদিয়া হাসলো, একটু লজ্জাও পেল। নাদিয়া বলল, ‘তো আমরা কি কোথাও যাবো নাকি তুমি এভাবে আমাকে দেখতেই থাকবে’?
তা নিয়ে যেতে পারি কিন্তু তার জন্য এখন তোমাকে বাইক চালানো শিখতে হবে।
‘কি! কেন’?
কারন তোমার ইচ্ছেগুলোর মধ্যে এটা একটা আর আমি সেগুলো পূরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
‘কেন’?
‘কারন তুমি আমার কাছে খুব স্পেসাল কেও একজন। তোমার প্রশ্ন করা শেষ হলে চলো আমরা এখন বাইক চালানো শিখায় মন দেয়’।
বলেই নীল তার বাইক নিয়ে আসলো । বাইক স্টার্ট দিয়ে তারপর নাদিয়াকে দেখিয়ে দিল কিভাবে চালাতে হয়। সবকিছু বিস্তারিত তাকে বুঝিয়ে বলল। কিভাবে গিয়ার দিতে হয়, এক্সিলেটর ঘোরাতে হয়। এখন প্র্যাক্টিসের পালা। নাদিয়া ড্রাইভ করছে আর পিছনে নীল বসে আছে।
চালাতে গিয়ে মাঝে মাঝে নাদিয়া কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছিল তখন বার বার নীল তাকে রক্ষা করেছে। একবার পরে গিয়ে নাদিয়ার একটু কেটে যাওয়াতেই নীল অস্থির হয়ে পরছে। এতেই বুঝা যায় নাদিয়ার প্রতি নীলের কেয়ার।
নাদিয়া অনেক্ষন প্র্যাক্টিস করার পর এখন বেশ ভালই চালাতে পারছে। নীল তাকে খানিক দূরে একটা ক্লাবে নিয়ে যেতে বলল।
‘আমরা এখানে কেন’? নাদিয়া বলল। তোমার দ্বিতীয় ইচ্ছা পূরণ করতে। সারারাত আমরা ক্লাবে পার্টি করব। এখন আর কোন প্রশ্ন নয়, চলো ভিতরে যাই। তাঁরা দুজনে ভিতরে প্রবেশ করল। সারা রাত তাঁরা ড্রিঙ্ক করল, নাচলো, অনেক মজা করল।
রাত তিনটা বাজলে নীল নাদিয়াকে নিয়ে ক্লাব হতে বের হয়ে আসলো। যদিও নাদিয়া বের হয়ে আসতে ইচ্ছুক ছিল না। নাদিয়া বাইক চালানোর মত স্বাভাবিক ছিলনা তাই এবার নীল ড্রাইভ করে নিয়ে আসলো। তাঁরা হসপিটালে পৌছেই সরাসরি ছাদে চলে গেল।
‘আমরা এখানে কি করছি, নীল। আমি ঘুমাবো। আমাকে রুমে রেখে আসো’, চিৎকার করতে করতে বলল নাদিয়া। নীল তার মুখ চেপে ধরে বলল, চুপ। সে ছাদে রাখা দুটো বিছানার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ‘এখন আমি তোমার তৃতীয় ইচ্ছে পূরণ করতে যাচ্ছি। খোলা আকাশের নিচে ছাদে ঘুমানো’।
নাদিয়া নীলের চিবুকে হাত রেখে বলল, ‘ওয়াও। তুমি খুব কিঊট। আমার জন্য এটা খুব স্পেশাল ব্যাপার। আমার স্বপ্ন গুলো যেন সত্যি হচ্ছে। কিন্তু দুটো বিছানা কেন? আমরা এক বিছানায় তো শুতে পারি! জলদি আসো। এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে কেন’? বলে নীলের হাত ধরে টান মেরে বেডে নিয়ে গেল নাদিয়া। নীল হাসছে তার এমন বাচ্চামি আচরন দেখে। নাদিয়া ঘুমানোর সময় নীলের বুকে মাথা রেখে এক হাত দিয়ে তাকে জরিয়ে ধরল।
নীল জানে যদিও নাদিয়া এখন সেন্স এ নেই তারপরও সে তার সঙ্গ খুব উপোভোগ করছে। এইদিকে হসপিটালের সবাই খুব চিন্তিত। সবাই তাদের খুজছে। তাঁরা ভাবছে নীল আর নাদিয়া হয়তো পালিয়ে গেছে। কিন্তু তারা তো আছে তাদের নিজস্ব পৃথিবীতে, সুন্দর কিছু মুহুর্ত উপোভগ করতে, খোলা আকাশে তাঁরার নিচে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নীলের গালে একটা চুমু দিল নাদিয়া। ‘তোমাকে ধন্যবাদ’। নীল চমকে উঠল নাদিয়ার এমন আচরনে। তার মানে নাদিয়াও তাকে ভালবাসে।
নাদিয়া চুপিচুপি তার রুমে ফিরে আসলো, কিন্তু তার মা তাকে দেখে ফেলল। তার মা তাকে দেখেই রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘তোমার কোন ধারনা আছে। এখন আসছো। সারা রাত কোথায় ছিলে? কত চিন্তা হচ্ছিল আমার’।
‘মা, আমি স্বপ্নের দেশে ছিলাম। আমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে। আমি দুঃখিত তোমাকে বলে যায়নি। কিন্তু আমি খুব আনন্দ করেছি আজ’। তার মা তাকে আগে কখনও এত খুশি দেখেনি। তাই তাকে আর কোন প্রশ্ন করলো না।
তাঁরা একে অপরের ফোন নাম্বার এক্সচেঞ্জ করে নিয়েছিল যেন কথা বলতে পারে। দুপুরে খাবার সময় ছাদে তাঁরা আবার দেখা করল। নীল নাদিয়ার জন্য নুডুলস নিয়ে এসেছে। নাদিয়া খুব খুশি হল। তাঁরা জানে তাদের স্বাস্থের জন্য এই খাবার ঠিক নয় কিন্তু মৃত্যুর আগে তাঁরা তাদের প্রিয় খাবার গুলো খেতে চাই। খাওয়া শেষে আবার সন্ধ্যাই দেখা করবে বলে সেখান থেকে তাঁরা চলে আসলো।
এর মধ্যে নাদিয়া আরেকবার নীলের মায়ের সাথে কথা বলল। নীলের মা আসবে বলে নাদিয়াকে আস্বস্ত করল। নীল তার জন্য অনেক কিছু করেছে। সেও নীলকে খুশি করতে চাই, কিন্তু সেটা তার বাবা মাকে নিয়ে আসা ছাড়া সম্ভব না।
সন্ধ্যায় নাদিয়া আসলো। নাদিয়াকে দেখে নীল চমকে উঠল। আজ নাদিয়া হসপিটালের পোশাক পরে আসেনি। তাকে দেখতে দারুন লাগছে। ভাষায় প্রকাশ করার মত না।
‘তোমার সৌন্দর্য দেখে কবে আমি মারাই যাব। তোমাকে অসাধারণ লাগছে দেখতে’। বলল নীল।
নাদিয়া হাসলো নীলের প্রসংসা শুনে। ‘তো আজকের প্ল্যান কি’, জিজ্ঞ্যেস করল নাদিয়া।
‘আজ প্ল্যান হচ্ছে তোমার শেষ দুটি ইচ্ছে পূরণ করা আর সাথে অবশ্য আমারও একটা ইচ্ছে পূরণ হবে’, বলল নীল।
নাদিয়া বুঝতে পারছে নীল কি করবে। নীল আজ তাকে প্রোপোজ করবে নিশ্চিত। কিন্তু নাদিয়া বুঝতে পারছে না, তার শেষ ইচ্ছে ছিল বিয়ে করা, তাহলে!
নীল নাদিয়াকে নিয়ে বিচে গেল তার চার নম্বর ইচ্ছে পূরণ করতে। তাঁরা বিচে হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে, আর তাদের চোখ কথা বলছে শুধু।
কিছুক্ষন পর নীল নিরবতা ভেঙ্গে জানতে চাইলো, ‘তোমার সব ইচ্ছে তো পুরন হল। কেমন লাগছে?’
নাদিয়া তাকে শক্ত করে বুকে জরিয়ে ধরে বলল, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে স্বরনীয় সময় ছিল। তোমার বাহুডোরে থাকার অনুভুতি বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমার সব ইচ্ছে তো পূরণ হয়নি, আরেকটা আছে’।
‘ওহ আচ্ছা। চলো সেটাও পূরণ করে ফেলি’।
নীল নাদিয়াকে চোখ বন্ধ করতে বলে তাকে কোলে তুলে নিল। সে সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে যেন সুন্দর ভাবে প্রোপোজ করতে পারে। গোলাপের পাপড়ি দিয়ে বানানো একটা হার্টের মধ্যে নিয়ে গিয়ে নাদিয়াকে নামালো। সেখানে গাছ, মাটি সব জায়গাই সুন্দর করে ‘আই লাভ ইউ’ লিখা প্ল্যাকার্ড লাগানো। নীল নাদিয়াকে এবার চোখ খুলতে বলল। তারপর হাটু গেড়ে বসে হাতে আংটিটা নিয়ে নাদিয়াকে প্রোপজ করল,
‘আমার পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তোমার মুখে হাসি ফুটাতে আমি সব করতে পারি। তুমি আমাকে ভালবাসার মানে শিখিয়েছ। আমাকে পুর্নতা দিয়েছ নাদিয়া। আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই। তোমাকে অনেক ভালবাসি। বিয়ে করবে আমাকে?’
খুশিতে নাদিয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। নাদিয়ার নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। সে নীলকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসি। আমি শুধুই তোমার। আমরা একসাথে বুড়ো হতে চাই, সারা জীবন কাটাতে চাই। কিন্তু.....’
নীল নাদিয়ার ঠোটে আলতো করে আঙ্গুল ছুয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ চলো এই মুহুর্তটা উপোভোগ করি, ভুলে যায় ভবিষ্যতে কি হবে!’ এই বলে নীল আংটিটা নাদিয়ার আঙ্গুলে পড়িয়ে দিল।
তাঁরা দুজনেই যেন সত্যিকারের ভালবাসা খুঁজে পেল। যেমনটা তাঁরা চেয়েছিল। তাঁরা কেউ ভাবেনি মাত্র দুদিনে এমনটা হতে পারে। আসলে ‘ভালবাসা মানে এটা নয় যে তাঁরা কয়দিন, কয় সপ্তাহ বা কয় মাস একসাথে থাকলো, বরং ভালবাসা মানে সেটাই যে তারা প্রত্যেকদিন একে অপরকে কত টুকু বেশি ভালবাসলো’।
‘নীল, আমার শেষ ইচ্ছা ছিল বিয়ে করা কিন্তু আমি এত বেশি ভালবাসা পেয়েছি যে এই এক জীবনে বিয়ে না করলেও চলবে আমার। সবকিছুর জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। যদিও আমরা বিবাহিত নই কিন্তু আমাদের সম্পর্ক টা আত্ত্বার। তোমাকে ভীষণ ভালবাসি’।
‘তোমার সব ইচ্ছে পূরণ হলো। আমি তোমার এই হাসি দেখার জন্য সব করতে পারি। ধন্যবাদ তোমাকে আমার জীবনে আসার জন্য। তোমার ভালবাসা দিয়ে আমাকে আলোকিত করার জন্য। আমার জীবনকে রাঙিয়ে তোলার জন্য’।
‘হ্যা। আমার সব ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। এখন আমি মরে গেলেও আমার আর কোন আফসোস নেই’।
‘চুপ করো, এমন কথা আর বলবেনা’।
রাত বাড়ছে। পাশাপাশি হাত ধরে নীল আর নাদিয়া হেটে চলেছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে সমুদ্র তীরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তাদের কথাও এগুতে থাকল।
হঠাৎ নাদিয়া অসুস্থ হয়ে পরল। নীল জলদি তাকে নিয়ে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসলো যে ওয়ার্ডে নাদিয়া ভর্তি ছিল। নাদিয়ার অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তার নাদিয়াকে বাচাতে আপ্রান চেষ্টা করছে।
নাদিয়ার মা কান্না করছে। সেটা দেখে নীল এগিয়ে এসে নাদিয়ার মায়ের পাশে দাড়ালো। উনাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে।
‘আন্টি, চিন্তা করবেন না, নাদিয়া ঠিক হয়ে যাবে’। তাঁরা দুজনেই জানে এটা মিথ্যা। নাদিয়া তার মাকে নীলের ব্যাপারে সব বলেছিল, তার জন্য কি কি করেছে সব।
নাদিয়ার মা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি নীল’?
নীল মাথা নাড়ালো।
‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার মেয়েকে সুখি করার জন্য’।
আন্টি আমি আপনার ছেলের মত এবং কোন মা তার সন্তানকে কখনো ধন্যবাদ দেয় না।
নীল খুব চেষ্টা করছে না কাদতে কিন্তু সে কিছুতেই নাদিয়াকে হারানোর ভয় মন হতে দূর করতে পারছে না। তখনই ডাক্তার দুসংবাদটা নিয়ে এল।
মুহুর্তের মধ্যেই নীলের পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যেতে লাগলো। সে এতই ধাক্কা খেল যে তার কান্না করার শক্তিটা পর্যন্ত নেই।
নাদিয়ার মা কাদছে কিন্তু তিনি এটা ভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছেন যে তার মেয়ে জীবনের শেষ কটা দিন আনন্দে কাটিয়েছে।
নীল তার রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। সে মানতে পারছে না নাদিয়া আর নেই।
পরদিন সকালে নীলের বাবা মা নাদিয়াকে দেয়া কথামত নীলকে দেখতে হস্পিটালে এসেছে। অনেকদিন পর তাদের দেখে নীল খুব খুশি হল। তাঁরা তাদের ভুল বুঝতে পেতে তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলো নীলের কাছে। নীল জানতো না যে তার বাবা মাকে নাদিয়াই আসতে বলেছে। নীল তার মায়ের সাথে অনেক কথা বলল, এতদিন যত না বলা কথা ছিল সব। এতে নীলের কষ্টগুলো একটু কমে গেল।
নীল তার বাবা মাকে তার এবং নাদিয়ার ব্যাপারে বলল। তখন তার মা বলল, ‘ওহ নাদিয়া, সেই তো আমাদের এখানে আসতে বলেছে এবং আমাদেরকে ভুল বুঝতে সাহায্য করেছে। আমি তার সাথে দেখা করতে চায়। কোথায় সে’?
এই কথা শুনে নীল এবার জোরে জোরে কাদতে লাগলো, নাদিয়াকে হারানোর ব্যাথায়। নীল শুনে অবাক হল যে নাদিয়া তাদের এখানে ডেকেছে তার ইচ্ছে পূরণ করতে।
‘নীল তুমি কাদছো কেন’?
‘মা, সে অনেক দূরে চলে গেছে আমাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য। সে গতকাল মারা গেছে’।
তার মা তার কাছে আসলো। পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘মাঝে মাঝে এমন হয়। আমরা যা চায় তা পাই না’।
নীলের বুক ফেটে কান্না আসছে। সে মাকে জরিয়ে ধরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল, ‘মা, নাদিয়া ছিল অতুলনীয়। এমনকি মারা যাবার পরেও আমার সব ইচ্ছে পূরণ করল’ বলেই নীল ও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
নীল আর নাদিয়া, তাদের দুজনেরই নিজস্ব কিছু ইচ্ছে ছিল এবং তাঁরা একে অন্যের সেই ইচ্ছে গুলো পূরণ করেছে।
যদিও মৃত্যু তাদের আলাদা করেছে কিন্তু স্বর্গে আবার তাঁরা মিলিত হবে আর তাদের ভালবাসাকে পুর্নতা দিবে যে গল্পটা এই পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল।
তাঁরা আলাদা ভাবে অসম্পুর্ন ছিল ঠিক কিন্তু একসাথে তাঁরা একে অপরকে পরিপুর্ন করেছে আর তাদের ছিল একটা পুর্ন ভালবাসার গল্প।
writer: Nure Alom Ripon
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন