বড় আপু তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। সামনে সমাপনী পরীক্ষা দিবে৷ আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। আপুর এক ক্লাস নিচে। গ্রামবাংলার তখনকার সমাপনী পরীক্ষা, মানে শিক্ষা জীবনের প্রথম বোর্ড পরীক্ষা দিতে যাওয়াটা ছিল অনেক বড়সড় একটি ব্যাপার। তার উপর আমাদের পরিবারের এই প্রথম কেউ বোর্ড পরীক্ষা দিতে যাবে, সেটি কি আর চাট্টিখানি কথা?
কেউ বাড়িতে বেড়াতে আসলে গল্পের এক পর্যায়ে
বাবাকে প্রায় বলতে শুনতাম, "জানো আমার বড় মেয়ে এবার সমাপনী পরীক্ষা দিবো৷ তবে সেটি আমাগো গেরামের ইস্কুলে না, ঐ শহরের বড় ইস্কুলে।" কথাটি বলার পর দেখতাম বাবা তৃপ্তির একটি নিঃশ্বাস ফেলতেন। গর্বে উনার বুকটা ভরে যেতো। আনন্দে চোখের দৃষ্টি ঝলমল করতো। সেই দৃশ্যটি দেখতে আমার কি যে ভালো লাগতো! আমি বাবার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতাম।
বাবা খুব সামান্য বেতনের কেরানীর চাকরি করতেন। মাস শেষে বেতনের যে টাকাটি পেতেন সেটি আম্মার হাতে তুলে দিতেন। বাবার বেতনের সেই সামান্য ক'টা টাকা দিয়ে অনেক কষ্টে কোনরকমে আম্মা সংসারটি টেনে নিতেন। কোনোদিন খেয়ে আবার কোনোদিন না খেয়ে আমাদের দিন চলে যেতো।
তখন ছিল নভেম্বর মাস। শীতের শুরু। নভেম্বরের ২০ তারিখ হতে আপুর পরীক্ষা শুরু। পরীক্ষার সপ্তাহ খানেক আগে থেকে সে পড়াশোনায় বেশ মনোযোগ দিতে লাগলো। তাঁকে দেখতাম খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতো। রাতে ঘুমানোর পাতলা একটি কাঁথা গায়ে জড়িয়ে টেবিলে বসে পড়তো। আমাদের কারোই শীতের কোনো সোয়েটার কিংবা ভারি উমের কোনো জামা কাপড় ছিল না। শীতকালে দুটো জামা একটির উপর আরেকটি পরে কিংবা খড়কুটোর আগুনের তাপে হাতপা গরম করে শীতকাল পার করে দিতাম।
তবে রাতে ঘুমানোর জন্য আমাদের দুটো পাতলা কাঁথা ছিল। আম্মার পুরনো কাপড় দিয়ে সেলাই করে বানানো। আমার ছোট চাচা বিদেশে থাকতেন। তাদের আলাদা সংসার। বিদেশ থেকে আসার সময় বড় বড় কম্বল নিয়ে আসতেন। কিন্তু আমার ছোট চাচি খুব হিসেবি মানুষ। একটি সুতোও এদিক সেদিক হতে দিতেন না। সেখানে আমাদেরকে একটি কম্বল দিয়ে দেওয়া তো অনেক দূরের বিষয়। এটি দুঃস্বপ্নেও আমার কল্পনা করতে পারি না। চাচির সাথে আমার চাচা কখনো কথায় পেরে উঠতে পারেন নি। আমার খুব ইচ্ছে হতো গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘুমানোর কিন্তু সেই ইচ্ছেটি আমার পূরণ হয়নি। আমাদের এত দারিদ্র্যতা দেখে মাঝেমাঝে খুব খারাপ লাগতো। খুব কষ্ট পেতাম।
সেদিন রাতে বাবাকে দেখলাম অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি খুশি হয়ে বাড়ি ফিরতে। এর কারণ ছিল বাবা সেদিন আপুর জন্য একটি সোয়েটার কিনে এনেছিলেন। কারণ দুদিন পর আপু পরীক্ষা দিতে যাবে। এই শীতে সোয়েটার ছাড়া এতদূর গিয়ে পরীক্ষা দিতে আপুর কষ্ট হবে। সেজন্য অনেক কষ্টে বেতনের থেকে অল্প কিছু টাকা জমিয়ে আপুর জন্য লাল রঙের একটি সোয়েটার কিনে আনলেন। আপু ছিল অনেক সুন্দর। তাই লাল রঙটাই নাকি ওকে বেশ মানাবে। সোয়েটার পেয়ে আপুর আনন্দের সীমা নেই। সেদিন সারারাত সে সোয়েটার গায়ে দিয়ে পড়েছিলো৷ এক মুহুর্তের জন্যও গা থেকে সোয়েটার খোলেনি এমনকি ঘুমায়ও নি৷
লাল সোয়েটার গায়ে দিয়ে আপু পরীক্ষা দিতে গেলো। আপুর এক বছর পর সেই একই সোয়েটার পরে আমিও সমাপনী পরীক্ষা দিলাম৷ গরমের দিনে আম্মা এটিকে ধুয়ে খুব যত্ন করে স্টিলের ট্রাঙ্কে তুলে রাখতেন৷ শীতের দিন আসলে আবার খোলে দিতেন। এভাবে আমরা প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুল শেষ করেছি একটি সোয়েটার পড়ে। বদলাবদলি করে পড়তাম। আবার মাঝেমধ্যে কাড়াকাড়ি লাগতাম। আবার মিলেমিশে যেতাম।
আপুর এক ক্লাস নিচে পড়ার সুবিধার্তে আর আপুর সাথে আমার বয়সের খুব একটি পার্থক্য না থাকার কারণে কখনো আমি নতুন বই, নতুন জামা, নতুন কিছুই পেতাম না। আপুর ব্যবহৃত জিনিসগুলো দিয়েই আমি পুষিয়ে নিতাম৷ ছোটবেলায় হয়তো বাবার কাছে নালিশ করতাম কেন আমাকে নতুন জামা নতুন বই কিনে দাও না বাবা? তখন বাবা কোনো উত্তর দিতেন না৷ আমার প্রশ্ন শুনে মুখটি মলিন হয়ে যেতো। উনি চুপ করে থাকতেন। তখন আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগত। কেন এসব জিজ্ঞেস করতে গেলাম? কেন বাবাকে কষ্ট দিলাম? তখন নিজেকে খুব বকতে ইচ্ছে হতো।
কিন্তু বড় হওয়ার পর যখন বাবার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে পারলাম বুঝতে পারলাম তখন থেকেই আর এই ছেলেমানুষী আবদার গুলোকে পাত্তা দিতাম না। সন্তানকে তার পছন্দের কোনোকিছু দিতে না পারার কষ্টটি তখন বুঝতে না পারলেও এখন এক যুগ পরে এসে খুব করে বুঝতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি।
আজ আমি আপু দুজনেই চাকরি করি। সংসারে কোনো অভাব নেই। প্রতিটি শীতে একেকজনে দুইটি তিনটি করে সোয়েটার কিনতে পারি। আলমারি ভর্তি লেপ কম্বল। কিন্তু মনে শান্তি নেই। সেই ছোটবেলায় একটি সোয়েটার গায়ে দিয়ে যতটুকু আনন্দ অনুভব করতাম তার বিন্দু পরিমাণ আনন্দ এখন পাই না। কারণ যাদের জন্য এত কষ্ট করে পড়াশোনা করলাম এত বড় হলাম তারাই তো আজ নেই। আজ তাদের অনেক সুখে থাকার কথা ছিল। তাদেরকে অনেক সুখে রাখার কথা ছিল আমাদের। অথচ আজ সুখ আছে কিন্তু সুখের মালিক নেই। এটিকে কি আদৌ সুখ বলা যায়? সব থেকেও যেন আমাদের আজ কিছু নেই। আমরা নিঃস্ব।
আমার খুব করে ইচ্ছে হয় সেই ছোটবেলায় ফিরে যেতে। একটি সোয়েটার দুজন মিলেমিশে পড়তে। ভোর রাতে আপুকে কাঁথা জড়িয়ে পড়তে দেখতে। আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়, আপুর সমাপনী পরীক্ষা দিতে যাওয়া নিয়ে বাবার আনন্দ মিশ্রিত মুখটি একটি বার দেখতে। আমার খুব ইচ্ছে হয় শীতের শেষে সেই লাল সোয়েটারটি ধুয়ে খুব যত্ন করে আম্মায় ট্রাঙ্কে তুলে রাখার দৃশ্যটি দেখতে। আমার খুব ইচ্ছে করে সেই পুরনো দিনগুলোতে আবার ফিরে যেতে..!!
লেখিকা ~ মাহদিয়া আঞ্জুম মাহি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন