রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২২

গল্প: টান

সেদিন আমি রেস্টুরেন্টে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছি। একজন বোরকা পরিহিতা মহিলা আমার সামনের টেবিলে বসে গালে হাত রেখে কি যেন ভাবছিলেন, সামনে খাবার রাখা তিনি খাবার খাচ্ছেন না! আমার মনে হয় মহিলাটি খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। খুব ইচ্ছা করছে মহিলার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে তার কি হয়েছে। পরক্ষণে ভাবলাম সে যদি কিছু মনে করে। সংকোচ কাটিয়ে কাছে গেলাম।

আন্টি আপনাকে অনেকক্ষণ দেখছি খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন, খাচ্ছেন না।
আমার কথা শুনে আন্টি চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকাইলেন।
কি বলব বাবা, পেটে প্রচন্ড ক্ষুদা খাবার অর্ডার করার পর খেয়াল হলো আমার কাছে টাকা নেই, মনে হয় বাসে ছিনতাই হয়ে গেছে, এখন আমি কি করব, খাবার খেতেও পারছিনা, আবার ফিরিয়ে নিতেও পারছি না।

আপনি খান আমি বিল দেবো।
আমার কথায় আন্টি বলল, সে কি করে হয়, তোমার টাকায় কেন খাবো।
মনে করেন আমি আপনার ছেলে।
ছেলের কথা শোনার পর আন্টি খাবার খাইলেন।

আন্টি ঢাকা আসছেন ডাক্তার দেখাইতে, কিন্তু টাকা ছিনতাই হয়ে যাওয়াতে গ্রামে চলে যেতে চাইছেন। আমি বললাম বাস ভাড়া তো নেই আপনার কাছে।

হে বাবা ভাড়া নেই কি করব, অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে ডাক্তার দেখাইতে আসলাম, কয়েকদিন যাবত বুকের ব্যথাটি বেশি।
আমার কেমন যেন মায়া লাগছে আন্টির প্রতি।
আমি আপনাকে ডাক্তার দেখিয়ে দেই।
না বাবা পরে তোমার টাকা কিভাবে দেবো।
সেটি আপনার ভাবতে হবে না।
ডাক্তার দেখাতে রাত হলো, আন্টিকে বললাম আমার বাসায় থাকতে, সে বলল, তুমি আমাকে বাসে তুলে দাও আমি চলে যেতে পারবো।

কিন্তু আমি কিছুটা জোর করে তাকে আমার বাসায় নিয়ে গেলাম।
বাসায় গিয়ে কলিংবেল চাপতেই, কাজের বুয়া দরজা খুলে দিল।
বুয়াকে বললাম আন্টিকে খাবার দিতে, আম্মু আব্বু কোথায় ওরা কি রাতের খাবার খেয়েছে।  
বুয়া বলল, হ্যাঁ খেয়েছে,আপনার আম্মু ঘুমের মেডিসিন খেয়ে ঘুমাচ্ছে আর আপনার আব্বু টিভি দেখছে।
আমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, সকালে উঠে আন্টিকে পেলাম না সারা বাসা খুঁজে, ব্যাপার কি কিছুই বুঝলাম না।

আম্মু আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম আন্টি কই, দুইজনেই বলল, কেউ না কি আন্টিকে দেখেন নি। কাজের বুয়ার কাছে জানতে চাইলাম সেও বলল, কিছু জানে না, আমার কাছে কেমন যেন রহস্য মনে হচ্ছে, একজন মহিলাকে আমি উপকার করলাম, আর সে আমাকে না বলেই চলে গেলো এটি আমি মানতে পারছি না।

কাল যখন রেস্টুরেন্টে আন্টির সাথে কথা বলছিলাম, তখন জেনে নিয়েছি আন্টির গ্রামের ঠিকানা। 

অফিস হতে দুইদিনের ছুটি নিয়ে আন্টিকে খুঁজতে বের হলাম, খোঁজ করার প্রধান কারণ হলো আমাকে না বলে কেন সে চলে গেলো, তার প্রতি কেমন অজানা একটি টান অনুভব হচ্ছে।

ঠিকানা অনুযায়ী আমি গ্রামে গিয়ে আন্টির বাসায় আসছি, একজন বৃদ্ধা বারান্দায় বসে ছিল, সে বলল, আমিনা কাল ঢাকা হতে আসার পর বিলাপ করে কান্না করছে।

জানতে চাইলাম সে কেন এতো কান্না করছে।

কান্না করবে না ২৫ বছর পর সে তার নিজের ছেলেকে দেখছে, তার ছেলে না কি তাকে খুব যত্ন করছে কিন্তু সে আসার সময় তার ছেলেকে না বলে চলে আসছে।

কেন না বলে চলে আসছে। 
সে অনেক ঘটনা। 
আমি ধীরে পায়ে আন্টির রুমে ঢুকলাম, আমাকে দেখে সে বিশ্বাস করতে পারছে না আমি তার সামনে। 
আচ্ছা আমিই কি তোমার ছেলে।
আন্টির মুখ হতে কথা বের হচ্ছেনা, সে কোনমতে বিছানা হতে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।

বাবারে তোরে আমি জন্ম দিয়ে কখনো এই বুকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি, আজ এতো বছর পর আল্লাহ আমার স্বাদ পূরণ করলো, তোর সঙ্গে কাল দেখা না হলে আমি মনে হয় বেঁচে থাকতে তোকে আর দেখতে পেতাম না।
কেন তুমি আমাকে জন্ম দিয়ে অন্যের কাছে দিয়ে দিলে।
আমার আব্বা তোর বাবার বাসায় কাজ করতো। 

আমরা গরিব ছিলাম, তোর বাবা আজমল আহমেদ  আমার আব্বাকে বলল, সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। তোর বাবা বিবাহিত, বিয়ের ১০ বছরে তার সন্তান হয়নি, শুনেছি তার স্ত্রীর সমস্যার কারণে সন্তান হবেনা, তাই আমাকে বিয়ে করতে চাইলে আমি রাজী হইনা, কিন্তু আমার মা বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে বিয়েতে রাজী করায়।
বিয়ের পর তুই যখন এই পৃথিবীতে আসলি আমি জ্ঞান ফেরার পর নার্সকে বললাম আমার ছেলে কই তাকে আমি কোলে নেবো।

নার্স আমাকে বলল, আপনার স্বামী বাচ্চা নিয়ে চলে গেছে, আমি পাগলের মতো ছুটে আসছি তোর জন্য, কিন্তু দারোয়ান আমাকে বাসার ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়নি, আমি অনেক কান্নাকাটি করছি অনেকের কাছে নালিশ করছি, তোর বাবা প্রভাবশালী বলে কেউ তোর বাবাকে কিছু বলতে সাহস পায়নি।

কিছুদিন পর তোর বাবা আমাকে ডিভোর্স দেয়, আমি বাসার সামনে তোকে দেখার জন্য প্রতিদিন যেতাম কান্না করতাম, রাস্তায় তোর বাবাকে পেলে পায়ে ধরে বলতাম আমার ছেলেকে আমি এক নজর দেখবো, আমাকে দেখতে দেয়নি তারপর তোকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে।

তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে আমি পাগলের মতো হয়ে যাই, সবসময় বুকে চিনচিন করে ব্যথা করতো তোর কথা মনে হলে,
তাইতো হার্টের অসুখে ভুগছি এতটি বছর। 

মা তোমার ছেলে তোমার কাছে ফিরে আসছে, এখন কেউ আমায় তোমার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবে না, আমি তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো, তোমাকে নিয়ে আমি অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবো। তার আগে ওই বাবা নামক অমানুষের সামনাসামনি হয়ে জানতে চাইবো কেন সে তোমার বুক খালি করছে, এখন আমি তাদের বুক খালি করব, সে এখন বুঝবে কারো বুক থেকে সন্তান কেড়ে নেবার কষ্ট কি। 

আমার মা এখন আমার সঙ্গে থাকে, এখন সে অনেক সুখী, আমি মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে ঘুমাই আম্মুর বুকে মাথা রাখি, নিজেকে ছোট বাচ্চা মনে হয়। যে মা আমাকে আদর যত্ন করে বড় করেছে তার বুকে মাথা রেখে অনেক রাত ঘুমিয়েছি কখনো এমন শান্তি পাইনি, আসলে মা তো মা ই হয়।

আমার মা গত ২৫ বছর যে কষ্ট পেয়েছে, সেই কষ্ট এখন আমার বাবা এবং যেই মা এত বছর আমাকে নিজের সন্তানের মত লালন পালন করছে সে পাচ্ছে।
একজনকে কষ্ট দিয়ে নিজে কখনো সুখে থাকা যায়না!
আমার মাকে আমি পেয়েছি এই দুনিয়ায় এটিই আমার সবচেয়ে বড় নিয়ামত। 
সমাপ্ত 
লিখেছে: jannat Nur

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন