অনেক বছর আগের ঘটনা,তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী ছিলাম। থাকতাম তাপসী রাবেয়া হলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়। প্রতিটি রুমে ওভার লোডেড ভর্তিচ্ছু ছাত্রী। তাদের পদচারণায় হল কানায় কানায় পূর্ণ। ফলে ক্যান্টিনে, ডাইনিংয়ে প্রচুর ভিড়।
রাতের খাবার খেতে ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখি খাবার শেষ। কী করি এখন? ভাবলাম ক্যান্টিন থেকে কিছু শুকনা খাবার কিনে রুমে গিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ি।
ক্যান্টিনে গিয়ে দেখি সেখানে লম্বা লাইন। দুই সারিতে মেয়েরা দাঁড়িয়ে সিরিয়ালি প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কেনাকাটা করছে। আমিও একটি লাইনের শেষ মাথায় দাঁড়ালাম।
প্রায় আধা ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আমি সিরিয়ালের প্রায় সামনে এসে গেছি। আমার সামনের মেয়েটি একটি ডিম কিনে পাঁচশো টাকার নোট দিল। ক্যান্টিন বয় বাবর আলী মোটামুটি বিরক্ত হয়ে বলছে,
- তিন টাকার ডিম নিয়ে পাঁচশো টাকা ভাঙতি হবে না। মামা আপনি যান, ভাঙতি নিয়ে আসুন।
মেয়েটি মন খারাপ করে লাইনের দিকে তাকিয়ে পুনরায় অনুরোধ করলো। মামা ডিমটি দিন প্লিজ। আমার কাল ভর্তি পরীক্ষা। আমার আবার লাইনে দাঁড়ানোর সময় হবে না। আমি রাতে খাব, মামা প্লিজ একটু দেখুন, প্লিজ মামা ।
মেয়েটির আকুতি আমার কানে গেলে আমি বাবরকে বললাম, ডিমটি দিয়ে দাও। আমি টাকা দিচ্ছি।
কথাটি শোনা মাত্রই মেয়েটি ডিম নিয়ে খুশীতে ঝলমল করতে করতে এক দৌড়ে চলে গেল।
আরও পড়ুন: মার্কিন দূতাবাসে নিয়োগ
আমি আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার পর মেয়েটির ডিমের দামসহ টাকা দিয়ে রুমে এসে রুমমেট বানাকে পুরো ঘটনা বললাম, দেখো বানা মেয়েটির ডিমের টাকা দিলাম অথচ মেয়েটি তো আমার রুম নম্বর বা নাম কিছুই জানতে চাইলো না। মেয়েটি কীভাবে আমাকে টাকা ফেরত দিবে?
- দূর, তুমিও না আছমা! এত বোকা! ও মেয়েকে দেখলে তুমি চিনবে? চিনবে না তো? তো টাকা ফেরত পাবার আশা ছেড়ে দাও। আমার রুমমেটরা এই নিয়ে হাসাহাসিই করলো। আমিও টাকা পাবার আশা ছেড়ে দিলাম।
পরদিন দুপুর তিনটায় আমার প্র্যাকটিকাল ক্লাশ। দুপুরের রোদের মধ্যে না হেঁটে হল থেকে রিক্সা করে ডিপার্টমেন্টের সামনে নামলাম। ভাড়া পাঁচ টাকা।
আমি রিক্সাওয়ালাকে বিশ টাকার নোট দিলাম।
- আমার কাছে তো ভাঙতি নাই মামা।
আমার কাছেও ভাঙতি নেই। দুপুরে আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। আবার পাঁচ টাকা ভাড়ার জন্য বিশ টাকা রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে চলে যাব ততটাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন হলের ডাইনিংয়ের মিল ছিল সাত টাকা। ফলে বিশ টাকায় হলের ডাইনিংয়ে একদিনের খাবার হয়ে যেত। তাই তখন বিশ টাকা আমার কাছে অনেক টাকা!
যাহোক আমি ও রিক্সাওয়ালা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছি। এই আশায় কেউ একজন আসুক এ রাস্তায় যে টাকাটি খুচরা করে দিতে পারবে।
হঠাৎ দেখলাম দুইজন ছেলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র হবে সেরকম মনে হচ্ছে । তবে আমি তাদেরকে চিনি না। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, ভাইয়া বিশটা টাকা ভাঙতি হবে? আমি রিক্সা ভাড়াটা দিতে পারছি না।
একজন ছেলে তৎক্ষণাৎ মানিব্যাগ বের করে কী যেন দেখলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাড়া কত?
পাঁচ টাকা- বলার সাথে সাথে সে পাঁচ টাকা রিক্সাওয়ালার হাতে দিয়ে বলল, ঠিক আছে মামা!
- জি মামা বলেই রিক্সাওয়ালা রিক্সায় টান দিলেন।
আমি তাকিয়ে দেখি টাকা দাতা ভাইয়া আমার কাছ থেকে টাকা না নিয়েই চলে যাচ্ছে।
আমি পেছন থেকে তাকে ডেকে বলছি, ভাইয়া টাকা তো নিলেন না।
তারা দুইজন কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আমার কথায় পেছনে ফিরে মুচকি হাসি দিয়ে একটা হাত সামান্য উপরে তুলে ইশারায় বললেন, ঠিক আাছে, তুমি ক্লাশে যাও।
আামি আশ্চর্য হযে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাকে পেছনে ফেলে তাদের চলে যাওয়া দেখছি। ভাবছি গতকাল রাতে হলের ক্যান্টিনে সম্পূর্ণ অচেনা একটি মেয়েকে আমি তিন টাকার ডিম কিনে দিয়েছিলাম। আজ ঠিক একই ভাবে অপরিচিত একটি ছেলে আমাকে পাঁচ টাকার রিক্সা ভাড়া দিয়ে দিল। আমি যা সাহায্য করলাম তার থেকে বেশী ফিরে পেলাম।
ঘটনাটি হয়ত খুবই সামান্য কিন্তু এই ছোট্র ঘটনাটি আমার জীবনের বিরাট শিক্ষা দিয়ে গেছে তা হলো - তুমি যদি মানুষের পাশে দাঁড়ালে মানুষও তোমার পাশে দাঁড়াবেই।
লিখেছেন Asma kobir
(সংগৃহীত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন