আমার বোন আর আমার স্বামীকে এক সঙ্গে রিক্সায় দেখে এক সাইডে দাঁড়ালাম। মূলত এই দৃশ্য দেখতেই আজ আমি বাসা থেকে বের হয়েছি। কয়েকদিন ধরে ওদের আমি খুব সন্দেহ করতাম। তাই আজ সকালেই বাসা থেকে বের হয়েছি। আমার বোন মিলি থাকে একটি হোস্টেলে। ওখানেরই একজন মেয়ে আমাকে বলেছে আমার স্বামীকে নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুড়তে যায়। ওদের কতগুলো ছবি তুলে রাখলাম। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না। ওখান থেকে সোজা বাসায় চলে গেলাম।
কোনো কিছু না জানিয়ে মিলি মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসে। আগে স্বাভাবিক ভাবলেও এখন ব্যপারটি অন্যরকম। আমি বড়বোন হয়ে মিলির কাছে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছি না।
বাসায় গিয়ে দেখি বাড়ির দরজা খোলা। কয়েকবার কলিংবেল বাজালাম। কিছু সময় পরে আবিদ দরজা খুলে আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। থতমত হয়ে জিজ্ঞেস করলো...
- মায়া তু তুমি? তোমার না হাসপাতালে যাওয়ার কথা?
- কেনো সমস্যা হলো নাকি?
- না, ভিতরে আসো।
আমি ভেতরে গিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলাম। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে নিচে ধপ করে বসে পড়লাম। আমার হাত পা এখনো কাঁপছে। মনে হচ্ছে চোখের সামনে নিজের দুনিয়াটা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে ভীষণ। আবিদকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। এত লড়াই, এত অপেক্ষা, এত ভালোবাসা, এত বিশ্বাসের প্রতিদান এভাবে দিলো? পারলো এমনটি করতে?? কখনো ভাবতেই পারিনি এমন একটি দিন দেখতে হবে।
আবিদের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো। কতক্ষণ এভাবে ভিজছিলাম মনে নেই। ঝর্ণার পানির আর চোখের পানি এক হয়ে গাল গড়িয়ে পড়ছে।
- কি হলো মায়া? এতক্ষণ কি করছো তুমি? ভিজছো নাকি এখনো? তোমার না ঠান্ডা লেগে যায় বেশি ভিজলে? এখনো বের হচ্ছো না কেন? মায়া?
- হ্যাঁ আসছি।
আবিদের কথা গুলো শুনে ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসলো। কত্ত নাটক!! একই সাথে দুজনকে খুশি রাখে! অন্য সময় এই কথাগুলোতে বেশ ভালোবাসা খুঁজে পেতাম। এক অজানা ভালো লাগায় মন ছেয়ে যেত। কিন্তু আজ আবিদকে মিলির সাথে দেখার পরে সমস্ত অনুভূতি যেন বিপরীত রূপে প্রকাশ পাচ্ছে।
চেঞ্জ করে চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে এলাম। আবিদ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি কিছু একটি বলতে যাবো। কিন্তু সুযোগ না দিয়েই ও বললো,
- তোমার জন্য একটি সারপ্রাইজ রয়েছে।
- কিসের সারপ্রাইজ?
- আরে বাবা! সারপ্রাইজটি কিসের সারপ্রাইজ, এটি বললে কি আর সেটি সারপ্রাইজ থাকে নাকি হুম??
- আমার ভালো লাগছে না। বললে বলো, আর নাহলে তোমার কাছেই রাখো তোমার সারপ্রাইজ।
বলেই আবিদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। আমার এমন ভাবলেশহীন উত্তর শুনে আবিদ কিছুটি আশাহত হলো। ও ভেবেছিলো যে আমি উৎসুক হয়ে সারপ্রাইজের কথাটি জানতে চাইবো। আবিদ আমার পেছন পেছন রান্নাঘরে আসলো। আমার সাথে কথা বলার চেস্টা করলো। কিন্তু আমি কোনো কথার উত্তর দেইনি। আসলে আমি ওর কথাগুলো শুনতেই পাচ্ছিনা। আমার মনে বারবার ওই ব্যাপারটি ঘুরপাক খাচ্ছে। একবার ভাবলাম ওর সাথে সরাসরি কথা বলব বিষয়টি নিয়ে। পরে মনে হলো কথা বলার তো কিছুই নেই। আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি দুজন হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাসি মুখে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলো। তাছাড়া আরো কয়েকবার ও নাকি ঘুরতে বের হয়েছে। এ থেকে সবই পরিষ্কার। তার থেকে নিজেই এ বাসা ছেড়ে চলে যাবো। কতো স্বপ্ন ছিলো, হাহহ!!
- মায়া তোমার কি হয়েছে বলবা? আমি কখন থেকে কথা বলে যাচ্ছি।
- হ্যাঁ বলো, শুনতে পাচ্ছি।
- এ কি রকম অদ্ভুত ব্যবহার?
- কেন কি হয়েছে?
- কিছুনা।
আবিদ কিছুটা রেগে সেখান থেকে চলে গেল। ওকে আমি ইগনোর করলে ও এরকম রেগে যায়। আগে এটিকে ভালোবাসা মনে করলেও এখন ওভার রিয়েক্ট মনে হচ্ছে!
দুপুরে খাবার খাওয়ার পরে আবিদ আমাকে একটি শাড়ি দিয়ে রেডি হয়ে নিতে বলে বাইরে চলে গেলো। আমি ও ওর কথামতো রেডি হয়ে নিলাম। কিসের সারপ্রাইজ দিবে আমি জানি। হয়তো ওর আর মিলির সম্পর্কটি আমাকে সরাসরি জানিয়ে দিবে যাতে আমি চলে যাই। আমি সেই ভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে গেলাম।
একটি বাসার নিচে আমাদের রিকশা থামলো। আবিদ আমার হাত ধরে ওপরে নিয়ে গেলো। তৃতীয় তলায় যেতেই আবিদ ওর হাত দিয়ে আমার চোখ বন্ধ করে ধরলো। আমি কিছুটি ভয় পেয়ে গেলাম। কি করতে চাচ্ছে আবিদ? আমার চোখ চেপে একটি রুমে ঢুকতেই সবাই এসে চিৎকার দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আবিদ আমার চোখ খুলে দিলো। মিলিকে দেখতে পেলাম। সাথে বাবা মা আর আমার বান্ধবী দের ও দেখলাম। অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছি।
আবিদ এসে হাটুগেড়ে আমার সামনে বসে পড়লো। হাতে একটি গোলাপ আর সুন্দর একটি চাবি আমার সামনে এগিয়ে দিলো। আমি চুপচাপ হাতে নিলাম।
- হ্যাপি এনভার্সারি। ৪র্থ বিবাহবার্ষিকী তে তোমার স্বপ্নের ফ্ল্যাট উপহার দিলাম তোমায়।
আমি যেন অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলাম।
- আবিদ আমার হাত ধরে বললো। কি ভেবেছিলে? মিলির সাথে আমার সম্পর্ক? তুমি জানোনা আমি ওকে কেমন চোখে দেখি? আজ পর্যন্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কখনো কথা বলতে দেখেছো? কিংবা শালীর মতো অপ্রয়োজনীয় রঙ তামাশা করতে দেখেছো? ছোট বোনের সাথে মানুষ যেমন কথা বলে আমিও তেমন ভাবেই বলি ওর সাথে। এটি তো জানোই।
আমি অবাক হলাম যে আমি এসব ভাবছি আবিদ কি করে জানে?
- ভাবছো আমি কি করে জানি? আসলে আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম। তাই চাচ্ছিলাম আজকের দিনটায় যেন তোমার পছন্দমতো ই সব করতে পারি। তাই আব্বা আম্মাকেও নিয়ে আসছি আমাদের নতুন বাসায়। আব্বা আম্মা আর মিলিকে নিয়ে শপিং এ গেছিলাম। আসলে আমি তো পুরুষ মানুষ, আর মিলি যতটা জানে আর বুঝে আমি তো ততটা জানিনা। তাই ওনাদের সবাইকে নিয়েই গেছিলাম। বা পাশের রিকশায় আব্বা আম্মা ছিলো। তুমি যখন আমাদের দেখছিলে তখন আগে মিলিই তোমাকে দেখে ফেলেছিলো। আর আমরা ইচ্ছে করে ই ওভাবে হেসে কথা বলছিলাম। যাতে সারপ্রাইজটি জোড়ালো হয়।
- কিন্তু একটি মেয়ে যে বললো তোমরা মাঝে মাঝে দেখা করো।
এবার মিলি আমার হাত ধরে বললো,
- আমাকে বিশ্বাস করিস? আর ভাইয়া কে বিশ্বাস করিস?
- হুম
- তাহলে শোন, একদিন বান্ধবীর বাসায় একটি নোট আনতে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম, রিকশা পাচ্ছিলাম না। তখন ভাইয়া অফিসে যাচ্ছিল। তখন সে আমাকে বান্ধবীর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েছিলো। তখন ১০ মিনিটের মতো ছিলাম। ব্যাস এটুকুই।
আমি অপরাধীর মতো আবিদের দিকে তাকালাম। আবিদ হাসিমুখে আমাকে বুকে টেনে নিলো।
- তোমার স্বপ্ন ছিলো একটি ফ্ল্যাটের। তাই এই ৪ বছর বসে টাকা জমিয়েছি। ব্যাস স্বপ্ন পূরণ করে নিলাম। এখন নিজের মন মতো সাজাও।
আমি এই অনুভূতি টা কিভাবে যে প্রকাশ করব বুঝতে পারছি না। তবে চোখ বেয়ে গালে পড়া উষ্ণ তরলের অস্তিত্ব ঠিকই বুঝতে পারছি।
by Md. Nazmul Huda
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন