সোমবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২২

থ্রিলার গল্প: সারপ্রাইজ

কক্সবাজারগামী এসি বাসে যাত্রী কেবল চারটি প্রাণী– আমি, আমার সমবয়সী একটি অচেনা ছেলে, আর একজন বয়স্ক ব্যক্তি আর বাসের ড্রাইভার। আমি বসে আছি সামনের দিকের একটি সিটে। আমার ঠিক সামনের সিটেই বসে আছে বুড়ো লোকটি, ইতিমধ্যে তিনি নাক ডেকে ঘুমানো শুরু করেছে। আর একটি সমবয়সী ছেলে বসে আছে বাসের প্রায় মাঝামাঝি বিপরীত দিকের সারিতে। এছাড়া, সম্পূর্ণ বাসটি খালি! ভাবা যায় ব্যাপারটি? মাত্র তিন জন যাত্রী নিয়ে গেলে তো বাসের তেলের খরচই উঠবে না!

অবশ্য, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! বাসে যাত্রী নেই, তার মানে এই নয় যে বাসের কোন টিকিট বিক্রি হয়নি! বাস ছাড়ার আগে কাউন্টারের লোক বললো- একটি একান্নবর্তী পরিবারের জ্ঞাতি-গুষ্টি সবাই মিলে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। তারা বাসের তিনটি বাদে সবগুলো টিকিট কিনে ফেলেছিল। কিন্তু তাদের কোন এক আত্মীয় মারা গেছে গেছে বলে যাত্রাটি ক্যানসেল হয়েছে। আর খালি বাসে কক্সবাজার যাওয়ার রেয়ার সুযোগ মিলেছে আমাদের তিন জনের – আমি, ঐ অচেনা ছেলেটি আর বুড়ো লোকটির।

আচ্ছা! বার বার তাকে আমি অচেনা ছেলে বলছি কেন? তার সাথে পরিচিত হয়ে নিলেই তো পারি! এত দূরের রাস্তা কী আর এভাবে নিভৃতে একা যাওয়া যায়? হাতঘড়িতে সময়টা দেখলাম আমি- রাত মাত্র সারে নয়টা বাজে। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করেও লাভ হবে না! 

আমি আমার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছেলেটি মাঝখানের এক সারিতে জানালার পাশের সিটে বসে আছে আমার সমবয়সী আর একটি ছেলে। আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “এক্সকিউজ মি ভাইজান। আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?”

ছেলেটি কানে হেডফোন লাগিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ আমার গলা শুনে চমকে উঠল। কান হতে তার হেড ফোন খুলে বলল, “জি? আমাকে কিছু বলছেন?”

ওরে বাবা! এতো দেখি বিনয়ের সাগর! আমি খানিকটা হতাশ হলাম। নাহ! ভদ্রলোকের ছেলের সাথে কথা জমবে না। তারপরও বললাম, “বলছিলাম যে আপনার পাশে কি একটু বসতে পারি? অনেক দূরের পথ যাচ্ছি। একা একা বোর লাগছে, ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলে সময় কাটবে ভাল।”

“জি অবশ্যই।” ছেলেটি সুন্দর করে হাসলো। “বসুন না।”

আমি বসে পড়লাম ছেলেটির পাশে। এরপর কয়েক মুহূর্ত নীরবে কাটল। ছেলেটি কেমন যেন শক্ত হয়ে বসে আছে! আমার মাথায় অবিন্যস্ত লম্বা চুল, নাকের নিচে তামিল ছবির নায়কদের মত ইয়া মোটা গোঁফ আর গালের কাটা দাগ দেখে খানিকটা হয়তো ভয় পেয়েছে।

আমি অভয়দানের ভঙ্গিতে হাসলাম। পরিবেশটি একটু স্বাভাবিক করতে বললাম, “ব্যাপারটি অদ্ভুত, তাই না? সম্পূর্ণ খালি বাসে চেপে কক্সবাজার যাচ্ছি! বিশ্বাসই হতে চাইছে না।”

“হ্যা, তবে ঐ ফ্যামিলির জন্য খারাপও লাগছে।” ছেলেটি বলল। “কত আশা করেছিল ফ্যামিলির সবাই মিলে সম্পূর্ণ বাস ভর্তি করে মজা করতে করতে কক্সবাজার যাবে! সেই মজা তাদের কান্নায় রুপ নিয়েছে।”

আমি একবার ভাবলাম বলি– “ভালোই তো হয়েছে! এক ফ্যামিলির সাথে ভ্রমনে যাওয়া আর একপাল বাঁদরের সাথে খাঁচার ভেতর বসে থাকার মধ্যে কোন তফাৎ নেই! সারাক্ষণ হই-হুল্লোড়, চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত!” কিন্তু এভাবে বললে এই ভদ্র ছেলেটি আবার মনে কষ্ট পেয়ে বসতে পারে, সেক্ষেত্রে আর আলাপ জমানোর কোন চান্স থাকবে না!

আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “বাই দ্য ওয়ে, আমি শোভন। ঢাকা ইউভার্সিটিতে জিওলজিতে মাস্টার্স পড়ছি। আপনি?”

“আমি পলাশ ঘোষ। নর্থ সাউথে এমবিএ পড়ছি।” ছেলেটি পুঁথি পাঠের মত করে কথা গুলো আউরে গেল। হাত বাড়িয়ে কোনও মতে হ্যান্ডশেক করেই আবার ছেড়ে দিল।

“বাহ আমরা তো দেখি সেইম ব্যাচ।” আমার গলায় একটি খুশি খুশি ভাব।

“তাই তো দেখছি।” নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল পলাশ।

ছেলেটি আর কথা না বাড়িয়ে আবার কানে ইয়ারফোন গুজে গান শুনতে শুরু করল। আজব তো! কই আমি আসলাম একটু গল্প করতে করতে! নাহ! এভাবে আলাপ জমানো যাবে না।

“কোত্থেকে যে এইসব ফার্মের মুরগী গুলো আসে!” আমি বিড়বিড় করে বললাম।

“আমাকে কিছু বললেন?” ছেলেটি কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নিল আবার।

“জি... মানে বলছিলাম...” একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। “বলছিলাম যে একা একা কক্সবাজার যাচ্ছেন কেন?”

“ওহ! একা না।” পলাশ একটু হেসে বলল। “ক্লাসমেটরা সবাই মিলে ট্যুর এ যাচ্ছি। সবাই আগেই চলে গেছে ওখানে। আমি একটু পার্সোনাল কাজে আটকে গিয়েছিলাম। তাই এখন একা যাচ্ছি।”

“ওহ! আচ্ছা! আচ্ছা!”

“আপনি কেন একা যাচ্ছেন?” এবার পলাশ জিজ্ঞেস করল আমাকে।

“আমি?” আমার মুখে ছোট একটিটা হাসি ফুটল। অনেকটা যেন নিজেকেই বলছি এমন ভঙ্গিতে বললাম, “আমি আসলে একাই চলতে পছন্দ করি। বন্ধু-বান্ধবের হই-হুল্লোড়ের চেয়ে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা নীরবে উপভোগ করতে বেশি ভাল লাগে আমার। তাই একাই যাচ্ছি।”

“বাহ! সুন্দর করে বললেন!” পলাশ একটু সহজ হয়েছে এখন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলছে। “একা একা খারাপ লাগে না কখনও?”

“নাহ!” আমি না-বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। “খারাপ লাগবে কেন? একাই তো ভাল আছি। বাসের ভেতর দুলতে দুলতে রাতের নিস্তব্ধতা উপভোগ করছি।”

“আপনি কি কবি নাকি?” পলাশের কণ্ঠে আগ্রহ।

“কেন জিজ্ঞেস করছেন?” আমি পালটা প্রশ্ন করলাম।

“শুনেছি কবিরা রাতের সৌন্দর্য একা একা উপভোগ করতে পছন্দ করেন!”

“শুধু কবিরাই রাত পছন্দ করে?” আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম একটু। “আর কেউ করে না?”

“আর কে করবে?” পলাশ অবাক।

“যেমন ধরেন, ভ্যাম্পায়ার! ভ্যাম্পায়াররা তো রাতে চলাচল করতে পছন্দ করে।”

পলাশ উচ্চশব্দে হেসে উঠল।

“কি ব্যাপার? হাসছেন কেন?”

পলাশের হাসি থামাতে খুব কষ্ট হচ্ছে, “হা হা হা... হাসব না? এইসব... হা হা হা... ভ্যাম্পায়ারে কেউ বিশ্বাস করে নাকি?”

“অন্যের কথা বাদ দিন।” আমি খুব স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলাম। “আপনি বিশ্বাস করেন কি না বলেন?”

পলাশ হাসি থামালো। একটু সিরিয়াস কণ্ঠে বললো, “জি না! আমি বিশ্বাস করি না।”

“ভেরি গুড।” আমি সম্মতিদানের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালাম।

এরপর বেশ কিছুক্ষন নীরবে কাটল। আমার একটু হাই উঠছে। ঘড়িতে সময় দেখলাম– ১১টা ৪৫। বাস কাচপুর ব্রিজ পার হয়ে এসেছে।

“আপনি বিশ্বাস করেন?” পলাশ প্রশ্ন করলো।

“কী?”

“আপনি ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস করেন কি?” পলাশ রিপিট করলো প্রশ্নটি।

আমি কিছু না বলে নীরবে হাসলাম।

“কি ব্যাপার? কিছু বলছেন না যে?”

“কি বলব বলুন?” আমি হতাশ কণ্ঠে বললাম। “বললে লোকে হাসে। কিন্তু তাই বলে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার তো করতে পারি না!”

“মানে?” পলাশ তো অবাক।

আমি আর কিছু বললাম না। হাই তুললাম আবার। ঘুম পাচ্ছে খুব।

“আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?”

পলাশ খানিকটা রেগে গেছে বুঝতে পারছি। আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, “সেটি একটু পরেই বুঝতে পারবেন।”

“কী বুঝতে পারব?” পলাশ আরও রেগে গেছে। “আপনি বলতে চাচ্ছেন যে আপনি ভ্যাম্পায়ার? এই কথা বিশ্বাস করতে বলছেন আমাকে? এই জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে একজন মানুষরূপী ভ্যাম্পায়ার? ফাজলামি করার আর যায়গা পান না?”

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, “একজন না ভাই। আন্তর্জাতিক জরিপ মতে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৭২১ জন ভ্যাম্পায়ার আছে। তাদের মধ্যে ২৩৬ জন বাংলাদেশ ভ্যাম্পায়ার সোসাইটির সদস্য। বাকিরা নীরবে নিভৃতে থাকে। পরিচয় দেয় না।”

“ভাই, মশকরা রাখুন এবার।” পলাশ সিরিয়াস কণ্ঠে বলল, “অনেক বিনোদন দিয়েছেন। আর দরকার হবে না।”

আমি থামলাম না। বলে চলেছি, “এই মুহূর্তে এই বাসের ভেতর মানুষ ও ভ্যাম্পায়ারের অনুপাত ১:১। অর্থাৎ, এই বাসে এখন দুজন মানুষ আর দুজন ভ্যাম্পায়ার আছে।”

“তাই নাকি?” পলাশ টিটকারির সুরে বলল, “আপনি ছাড়া আর কে ভ্যাম্পায়ার এখানে? ঐ বয়স্ক লোকটি?”

“না।” আমি মাথা নাড়লাম। “বাসের ড্রাইভার মতিন ভাই।”

“এনাফ! অনেক হয়েছে!” চিৎকার করে উঠল পলাশ। “আপনি দয়া করে উঠুন। অন্য কোন সিটে গিয়ে বসুন। আমার পাশে আপনাকে আর বসতে হবে না। কি ভাবছেন আমাকে? বোকারাম? এইসব লেইম ফাজলামো করে ভয় পাইয়ে দেবেন? এই সবে ভয় পাই না আমি!”

আমি কিছু বললাম না। পকেট থেকে একগাঁদা টিকিট বের করলাম। মুঠো করে হাতটি পলাশের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম, “এইগুলা কী? দেখেছেন?”

“কী এইগুলা?”

“বাসের টিকিট!” আমি খুব শান্ত কণ্ঠে বললো। “একান্নবর্তী পরিবার, সবাই মিলে ভ্রমনে যাবে, আত্মীয় মারা যাওয়ায় ট্রিপ ক্যান্সেল করেছে– এই সব ভুয়া। আসলে বাসের সমস্ত টিকিট কেটে নিয়েছিলাম আমি। দুটো টিকিট বাদে। দুজন সাধারণ যাত্রী নিয়েছি মাত্র। যাত্রাপথে আমি আর মতিন ভাই যেনো তাদের রক্ত খেতে পারি। আমরা প্রায়ই এই কাজটি করি। কেউ কিচ্ছু টের পায় না। এবার বিশ্বাস হয়েছে?”

“আ... আপনি ইচ্ছে করে...” রাগে কাঁপছে পলাশ। দাঁত মুখ খিঁচে বললো, “আপনি প্ল্যান করে এসেছেন আমাকে ভয় দেখানোর জন্য... দেখুন... আমি সহজে ভয় পাই না। এইসব করে লাভ হবে না। আমি জানি এইগুলা আসল টিকিট না।”

“আসল টিকিট না?” আমি চ্যালেঞ্জ দেওয়ার সুরে বললাম, “ঠিক আছে আপনি পরীক্ষা করে দেখুন! আপনার নিজের টিকিটের সাথে মিলিয়ে দেখুন। তাহলে বুঝবেন টিকিট আসল না নকল।”

“আমি কিচ্ছু পরীক্ষা করতে চাই না!” পলাশ ভেতর ভেতর ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু তা ঢাকার জন্য চিৎকার করছে! “আপনি উঠুন বলছি। নইলে কিন্তু আমি গায়ে হাত দিতে বাধ্য হব।”

আমি বিনা বাক্যব্যয়ে টিকিটগুলো আবার পকেটে ভরলাম। হাতঘড়িতে সময় দেখলাম। বারোটা বেজে গেছে। আরও একটি হাই তুললাম। আড়মোড়া ভাঙলাম। তারপর বললাম, “গায়ে হাত দিতে হবে না। আমি এমনিই উঠতাম। বারোটা বেজে গেছে। অর্থাৎ মানুষের রক্ত খাওয়ার সময় হয়েছে আমাদের।”

পলাশের চোখে মুখে আতংক। আমি এত স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলছি দেখে সম্ভবত সে দ্বিধায় পড়ে গেছে।

“আমাকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই।” আমার ঠোঁটে মুচকি হাসি। “আমি আপনার রক্ত খাব না। আপনার উপরে নজর পড়েছে ড্রাইভার মতিন ভাইয়ের। উনি আপনার রক্ত খাবে। আমি যাই, ঐ বুড়োর রক্ত খেয়ে আসি।”

উঠে দাঁড়ালাম আমি। এগিয়ে গেলাম বুড়ো লোকটির কাছে। না তাকিয়েও বুঝলাম পলাশ আমার পেছন থেকে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সামনের দিকে এসে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললাম, “ও মতিন ভাই? ১২টা বাজে তো! রক্ত খাইবেন না?”

“হ ভাই। খামু।”

বুড়ো লোকটি ঘুমিয়ে ছিল। আর আমি তার পাশের সিটে বসলাম। লোকটি কিচ্ছু টের পেল না। নির্বিঘ্নে ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দিলাম। বুড়োটি প্রথমে চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালো। তারপর কী হচ্ছে বুঝতে পেরে আঁতকে উঠল। এরপর প্রচন্ড আর্ত চিৎকার। বেশিক্ষণ চেঁচাতে পারল না লোকটিটা। এক কামড়ে তার ধমনী ছিঁড়ে ফেললাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকল। আমি ঠোঁট বসিয়ে চুমুকে চুমুকে রক্ত খেতে থাকলাম। খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ালাম। বুড়ো লোকটির প্রাণহীন দেহ সিটে ঢলে পড়ল।

বাসটি এখন একটি নির্জন রাস্তা ধরে যাচ্ছে। ড্রাইভার মতিন ভাই বাস থামালেন রাস্তার পাশে। তারপর দুজনে মিলে এগিয়ে গেলাম পলাশের দিকে।

পলাশ মৃগী রোগীদের মত থরথর করে কাঁপছে। এমন ভয় সে জীবনে পায়নি। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার গায়ের কাপড় চোপড় রক্তে মাখামাখি। বড় বড় চোখ বের করে পলাশ আমাকে দেখছে। তার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে বললাম, “আহ! কী শান্তি! প্রায় দুই মাস পর মানুষের রক্ত খেলাম আজ। এবার আমার কথা বিশ্বাস হয়েছে পলাশ?”

পলাশের দেহটি সিটের উপর ডাঙায় তোলা মাছের মত লাফাচ্ছে। কী যেন বলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কাঁপুনির কারণে গলা দিয়ে কেবল দুর্বোধ্য আওয়াজ বের হচ্ছে। তার দৃষ্টিতে ভয় আর আতংকের অপূর্ব সমন্বয়! পারলে এখনই জানালা খুলে বাইরে লাফিয়ে পরে আর কী!

আমি বললাম, “পলাশ! এখন আপনার রক্ত খাবে আমাদের ড্রাইভার মতিন ভাই। আপনি প্লিজ হাত পা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে একটু কো-অপারেট করুন।”

মতিন এগিয়ে গেল পলাশের দিকে। চোখে লোলুপ দৃষ্টি। 

আমি আরও ভয়ংকর কিছু কথা বলতাম হয়তো। কিন্তু না সে সুযোগ পেলাম না। তার আগেই ঝট করে খুলে গেল বাসের দরজা। হই হুল্লোড় করতে করতে একদল ছেলে মেয়ে বাসের ভেতর উঠতে থাকল। আমি হেসে ফেললাম। আর একটানে মাথা থেকে লম্বা চুলের উইগটা খুলে ফেললাম। নাকের নিচে বসানো আলগা গোঁফটিও খুলে হাতে নিলাম।

চিৎকার করে বললাম, “সারপ্রাইজ!”

পলাশের চোখে মুখে হতভম্ব দৃষ্টি। ভয়ে কাঁপছে এখনও।

“আরে তুই এখনও ভয় পাচ্ছিস?” আমার মুখে ভুবন জয় করার হাসি। “ভাল করে দেখ আমাকে। আমি নাজিম। তোর বেস্ট ফ্রেন্ড!”

এর মধ্যে বুড়ো লোকের ছদ্মবেশে থাকা আমাদের আরেক বন্ধু কামালও উঠে এসেছে। ওর মুখের উপর থেকে বয়স্ক লোকের মুখোশটি টেনে খুলে নিল। বললো, “কি রে? কেমন ভয় দেখালাম বল? তুই না বলিস ভুত প্রেতে ভয় পাস না?”

আমি বললাম, “দারুণ অভিনয় করেছি না বল? ড্রাইভার ভাইও কিন্তু জটিল অভিনয় করেছে আমাদের সাথে!”

পেছন থেকে আমাদের অন্যান্য বন্ধু বান্ধবেরা চিৎকার করছে, “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ ডিয়ার পলাশ...”

পলাশের কাঁপাকাঁপি থেমেছে। কিন্তু চোখে এখনও উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। আমি বললাম, “আরে গাধা! আমরা সবাই মিলে তোর জন্মদিন উপলক্ষ্যে তোকে সারপ্রাইজ দিলাম। কেউ এখনও কক্সবাজার যায়নি। সবাই এই বাসে করেই যাবে। ওরা আগে থেকে এই রাস্তায় এসে অপেক্ষা করছিল। আসার পথে সুযোগ পেয়ে আমি, কামাল আর ড্রাইভার ভাই মিলে তোর সাথে ড্রামা করলাম। তুই না সব সময় বলিস- ‘ভুত প্রেতে ভয় পাস না’? কেমন ভয় দেখালাম বল এখন?”

পলাশ আর কিছু বলছে না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

কামাল এগিয়ে গেল তার দিকে, “এই পলাশ। তুই কিছু বলছিস না কেন?”

কামাল পলাশের কাঁধে হাত রাখতেই পলাশের দেহটি সিটের উপর ঢলে পড়ল। 

আমি আঁতকে উঠলাম, “আরে! ব্যাটা তো মারাত্মক ভয় পেয়েছে! ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি?”

কামাল হাত বাড়িয়ে পলাশের নাড়িটি দেখল। ঝট করে উঠে দাঁড়াল। চোখে হতভম্ব দৃষ্টি!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে কামাল?”

কামাল কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “নাজিম! কী করেছি আমরা? পলাশ তো ভয়ে হার্টফেল করে মারা গেছে।”

কথাটি একটি ধাক্কার মত লাগল আমার গায়ে! চোখের সামনে দুনিয়াটা ঘুরতে থাকলো। মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন