স্বামী বাসর ঘরে আমায় যখন বলেছিলো,
-আমি তোমায় শুধু এই জীবনের জন্যে নয়, পরকালেও চাই।
এই কথাটি শুনে আমার মুখটা হাস্যজ্বল হয়ে গেলো। দেখলাম তিনি আবারও আমাকে বলতে লাগলেন,
-পরকালেও চাই বলতে কিন্তু তুমি শুধু পর্দা ঠিক মত পালন করে, হালাল হারাম মেনে চলে, সারাক্ষণ আমল করলেই চলবে না। দুনিয়ার কথাও ভাবতে হবে। শুধু আমায় ভালোবাসলে সেবা করলেই হবে না। আমার মা বাবাকে সেবাও করতে হবে। আর আমার বোনের সাথে কখনো হিংসা করা যাবে না। আমার মা অপরাধ করলেও তাকে অসম্মান করে উঁচু গলায়, কষ্ট দিয়ে কিছু বলা যাবে না।আমার পরিবারের মানুষ সবাই তোমার সাথে অন্যায় কিছু করলেও তুমি সবসময় তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে।
এতগুলো কথা একটানে বলা শেষ করে আমার দিকে যখন প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো আমি জবাব দিলাম,
-ঠিক আছে চেষ্টা করবো।
তাকে ঠিক আছে বললেও মনের মধ্যে তার প্রতি একটি ভয় কাজ করা শুরু করলো।এতো কড়া কথা আজ রাতে না বললেও পারতো।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই রান্না ঘরে চলে গেলাম। দেরি করে ঘুমালেও যদি কিছু বলে এই ভয়ে।তবে সেখানে গিয়ে দেখলাম শাশুড়ী মা আগে থেকেই রান্না শুরু করে দিয়েছে। আমাকে দেখেই রুমে চলে আসতে বললো।আমি তার সাথে জোর করেও পারিনি,চলে আসলাম।
ছোট ননদটি প্রায়ই আমার রুমে এসে গল্প করে, আমাকে সাজিয়ে দেয়।মাঝে মাঝে আমার রুমের কম্পিউটার থেকে সে কার্টুন ভিডিও দেখে। ননদ ভাবি এভাবেই সময় কেটে যায়। ননদ অবশ্য আমাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতে চাইলেও আমি দেই না। একদিন আমার বাসা থেকে বাবা ভিডিও কল করে। ননদ আমার রুমেই কম্পিউটার দেখছিল।বাবা ননদকে আমার রুমে দেখে বিষয়টি পছন্দ করে না। আমাকে ইংগিত করে কিছু বলতে চায়।আমি কথা পাল্টে দেই। আমি পারতাম বাবার সাথে সায় দিতে,ননদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে। কিন্তু আমি তা করিনি।বাবাকে সুযোগ দিলে সে আরেকদিন অন্য যেকোনো কথা বলার সুযোগ পাবে।আমি চাই না আমার সংসারে আমার বাবার বাড়ির কেউ মাতব্বরি করুক।সারাজীবন থাকবো যাদের সাথে, তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা মোটেও ঠিক না।
তাছাড়া বাবার কথায় ননদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম কোন কারণে? তার ভাইয়ের টাকায় কেনা কম্পিউটার সে ব্যবহার করছে,তার অধিকার আছে। এমন তো নয় যে, আমার স্বামীর সাথে আমাকে আলাদা সময় কাটাতে কখনো ব্যাঘাত ঘটায়। ওর ভাইয়া অন্য কাজে যখন ব্যস্ত থাকে, আমি রুমে একা থাকলেই কেবল আসে। সবকিছু পজিটিভ ভাবে নিলেই সংসার জীবনটি সুখের।
প্রত্যেকটি মানুষ ভিন্ন, সবার মতামতও ভিন্ন। একসাথে থাকতে গেলে আমাদের মতের কখনো মিল, কখনো বা অমিল হয়। তাই বলে সেটি নিয়ে কেউ কখনো তর্ক কিংবা কথা-কাটাকাটি করিনি।শাশুড়ী মায়ের কথায় কখনো কষ্ট পাইনি বিষয়টা এতো সহজ না।হ্যাঁ, কষ্ট পেয়েছি তবে তার ত্রিশ দিনের ভালোবাসার কাছে এক দিনের খারাপ ব্যবহার বিয়োগ করে দিয়েছি।তাছাড়া যে ভালোবাসতে পারে সে-ই শাসন করার অধিকার রাখে।আমাদের শাশুড়ী মা যথেষ্ট ভালো বাসলেও মাঝে মাঝে আমাকে খোঁচা মেরে কথা শুনাতো।আমি সেটি শুনেও, না শুনার মত থাকতাম। পাল্টা কখনো খারাপ ব্যবহার কিংবা অসম্মান করিনি।বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীর সাথে করা ওয়াদার কথাটি সারাজীবন পালন করার চেষ্টা করেছি।
এভাবেই চলছিল আমার সংসার জীবন। কয়েক বছর পর আমার কোল জুড়ে এলো ছেলে বাবু। শাশুড়ী মা আর ননদ আমার গর্ভকালীন সময় থেকে শুরু করে বাচ্চা হওয়ার পরও কতটি সাহায্য সহযোগিতা করেছে তা আমি অস্বীকার করতে পারবো না। একসময় ননদের বিয়ে হয়ে সে চলে গেলো।সে প্রায়ই আমার জন্য প্রচুর উপহার নিয়ে স্বামী সহ বেড়াতে আসে।যাওয়ার সময় আমিও অনেক উপহার দিয়ে দেই।
সংসার জীবনের চলে গেছে কতগুলো বছর। শাশুড়ী কিছু মাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে ছিল। আমি মোটেও অবহেলা করিনি।তাকে অনেক যত্ন করেছি। মাঝে মাঝে তার সুস্থ সময়ের খোঁচা মারা কথা মনে পরে অনিচ্ছা হতো সেবা করার।কিন্তু তার ভালোবাসার কথা মনে হলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো,ছি কিভাবে খারাপ চিন্তা আসতে পারে!
শাশুড়ী মা অসুস্থ অবস্থায় একদিন বললেন, তাকে আমার স্বামী আমার বিয়ের আগের রাতেই বলেছিল,
-মা আমার বউ কোনো ভুল করলে বুঝিয়ে বলবে।কটাক্ষ করে, মনে কষ্ট দিয়ে কিছু বলবে না। অন্য পরিবারের একটি মেয়ে আমাদের পরিবারের সাথে খাপ খাওয়াতে একটু সময় লাগবে।এই বিষয়টি সবসময় মনে রাখবে।
এভাবে ননদকেও বলে দিয়েছিল।আলাদা ভাবে সবাই কে বুঝিয়েছে,যেন সবাই তাদের দিক থেকে কোনো অন্যায় না করে।
সেদিন বাসর রাতে স্বামীর ওপর কিছুটা রাগ হলেও এখন বুঝতে পারছি। সে শুধু আমাকেই নয়, তার পরিবারের মানুষকেও বুঝিয়েছিল। মানুষটা গত হয়েছে বহুবছর পার হয়ে গেলেও, তার কথা সবসময় মেনে চলতাম। একসময় শাশুড়ী মাও চলে গেলেন।
ছেলে বিয়ে করালাম, ছেলের বউ এলো, নাতি নাতনি হলো।
আমার শাশুড়ীর মত আমার অবস্থানও এখন বিছানায়। আমি যেমন আমার শাশুড়ির জন্য করেছি এখন আমার ছেলের বউও আমার জন্য সেবা করে। শক্তি থাকতে বউয়ের সাথে উঁচু গলায় কিছু বললেও, আমার ছেলের বউ আমার মতই চুপ করে থাকতো। কখনো অসম্মান করেনি আমাকে। আমার শাসন করা সে ভালো ভাবেই নিয়েছে। আমার প্রতি বিরূপ ধারণা তার কখনো আসতে দেখিনি।
সেদিন বাবার কথায় যদি ননদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম।আমার প্রতি ননদের যেমন খারাপ চিন্তা হতো, শাশুড়ীরও হতো। এভাবে ছোটখাটো আরো অনেক বিষয়ে সবার প্রতি সবার হিংসা বিদ্বেষ তৈরি হতো। সংসারের সুখ শান্তি নষ্ট হয়ে যেত।
বিছানায় শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটো ভিজে এলো। আমার ননদকে ফোন করে আনা হয়েছে আমায় দেখতে। আমার চারপাশে আমার ছেলে, ছেলের বউ, নাতি নাতনি, ননদের পুরো পরিবার আছে। কেউ কাঁদছে, কেউ কুরআন শরীফ পড়ে খতম দিচ্ছে।
আমি সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। ছেলের বউ কে কাছে এনে আমার বুকের সাথে ধরে রেখেছি। আমি তাকে মন ভরে দোয়া করে দিলাম। এমন ভাবে আমার শাশুড়ীও আমার জন্য দোয়া করেছিলো দুহাত প্রসারিত করে।
ছেলের বউ আমার হুহু করে কাঁদছে। পুরো পরিবারও কাঁদছে। কিন্তু আমি আর এখন কাঁদছি না। প্রশান্তির হাসি হাসছি। চোখের সামনে ভেসে এলো একদিন বাবার আদরের মেয়ে থেকে বউ,বউ থেকে মা, মা থেকে শাশুড়ী হয়ে উঠলাম। এক নারীর কত রুপ!ভিন্ন রুপে ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। সব নারী যদি বুঝতো, সময়ের পরিবর্তনে সবগুলো রুপই ধাপে ধাপে জীবনে আসবে। তবে কেউ কখনো যৌবন কালে বৃদ্ধ শাশুড়ির সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারতো না।
আজ খুব করে আমার স্বামীর কথা মনে পরছে। তার সুন্দর কথা গুলো যদি আমি না মানতাম আজ হয়তো আমার জীবন এতোটা সুন্দর হতো না, সবাই আমাকে এতোটা ভালোবাসতো না, আমার ছেলের বউ আমার বুকে মাথা রেখে কান্না করতো না।
আমি সবার দিকে আরেকবার ভালো করে তাকিয়ে হাসলাম। সাথে সাথে আমার চোখ দুটো থেকে জল গড়িয়ে পরলো। এই জল কিন্তু কষ্টের নয়, একজীবনে অনেক বেশি প্রাপ্তির।
লেখক: সাদিয়া আফরিন মার্জান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন