কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে নাদিয়া আলী। অপরপ্রান্তে নাদিয়া আলীর স্বামী জনি। যিনি আর কিছুক্ষণেই প্রাক্তন স্বামী হয়ে যাবে।
উকিল একটু সময় দিয়েছে ওদের। অনেক দিন পর নাদিয়া আলী জনিকে দেখছে। ছয়মাস ধরে সেপারেশন চলছিল। উকিল বলেছে, এতদিন পর দেখা দু'জন দু'জনার চোখের দিকে তাকাও, মায়া হলেও হতে পারে।
নাদিয়া চোখ তুলে তাকায় জনির দিকে!
সবকিছু যেন স্পষ্ট হচ্ছে চোখের সামনে। সেদিন ছিল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির দিন। বিকেলে জানতে পারে রাতে তার বিয়ে হবে। কেমন একটি অনুভূতি হচ্ছিল। মামাতো বোন বারবার করে বলছিল, তুই এ যুগের মেয়ে হয়ে ছেলেকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হলি কেমনে নিলু, পরে যদি পছন্দ না হয়?
নাদিয়া আলী বলেছিল, "আব্বা দেখেছে, ছেলে লম্বা, মোটামুটি সুন্দর। আমি আর দেখতে চাই না।"
বিয়ে নিয়ে নাদিয়ার কখনোই অমত ছিল না। ছোট থেকেই সে বিয়ে করতে চাইতো। একটি পুরুষ মানুষ তার আশেপাশে ঘুরঘুর করবে ভাবতেই অন্যরকম অনুভূতি জাগতো মনের ভেতর।
বিয়ে পড়িয়ে যখন শ্বশুর বাড়ি নিয়ে আসা হচ্ছিল তখনও নাদিয়া বরের মুখ দেখেনি। একেবারে বাসর ঘরে প্রথম দেখা। প্রথম দেখাতেই নাদিয়ার মনে প্রাণে ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গিয়েছিল।
একবার জ্বর হলো নাদিয়ার। সামান্য জ্বরেই জনি পাগল প্রায়। হাতে পায়ে তেল দিয়ে দেয়, চুল আঁচড়ে দেয়, খাবার খাওয়ায়ে দেয়। এতো যত্ন নাদিয়া নিজের বাবার বাড়িতেও পায়নি কখনো।
জনির অবস্থা খুব যে ভালো ছিল তা নয়।
তীল তীল করে নাদিয়া সংসার গুছিয়েছে। দুটো বাচ্চার দেখভাল করা সবকিছু মিলিয়ে সুন্দর ভাবেই সময় চলে যাচ্ছিল। দীর্ঘ বারোটি বছর চলে গেছে অথচ একবারের জন্যেও মনে হয়নি এ সংসার ছেড়ে নাদিয়াকে কোনদিন চলে যেতে হবে।
সামান্য কারণে জনি নাদিয়ার গায়ে প্রথম হাত তুলে পাশের বাড়ির এক লোকের সাথে গল্প করার অপরাধে। নাদিয়া প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনে আর কখনও ওই লোকের সাথে গল্প করবে না। অথচ জনি লোকটিকে জড়িয়ে নোংরা নোংরা কথা শুনাতে লাগলো। এক পর্যায়ে নাদিয়ারও আর সহ্য হতো না। শুরু হতো ঝগড়া।
হঠাৎ একদিন জনির ফোন গ্যালারিতে ঢুকে দেখে এক মেয়ে জনির কাঁধে মাথা দিয়ে আছে। নাদিয়ার পৃথিবী যেন উলট পালট হয়ে যায়। জনিকে প্রশ্ন করলে সে সবকিছু স্বীকার করে বলে, মেয়েটির সাথে তার রিলেশন চলছে, তাকে বিয়ে করতে চায়। তবে নাদিয়াকেও ছাড়তে চায় না।
মেয়েটির সাথে কথা বলা বন্ধ করতে নাদিয়া আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়, শুরু হয় দাম্পত্য কলহ।
একদিন কথা কাটাকাটিতে নাদিয়াকে প্রচণ্ড মারে। নাদিয়া ব্যাগ গুছিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায়। ভাবে কিছুদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে।
এত বছর পর এ জীবন চিনতে পারে না নাদিয়া। সবকিছু যেন দ্রুত ঘটছে।
কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর নাদিয়ার মনের ভেতর আত্মমর্যাদা ভর করে। ভাবে কই জনি তো কখনো ফোন করে না? ছেলেমেয়েদের খোঁজ নেয় না? একবার বলেও না, যা হয়েছে হয়েছে তুমি চলে আসো?
নাদিয়া অপেক্ষা করে জনি একবার শুধু বলবে চলে আসো নাদিয়া, তাহলে সে ছুটে চলে যাবে। বলবে, আর কখনো এমন হবে না।
সে ভাবে কত সুন্দর সাজানো সংসার ছিল আমাদের, জনি কত ভালোবাসতে আমাকে! আদৌও কি জনি তাকে ভালোবাসতো, কিংবা আমরা সুখী ছিলাম? নাকি সব ধোঁকা ছিল। নাদিয়া কখনো ভেবে দেখেনি। কিন্তু ভাবা উচিত ছিল জনি শুধু কর্তব্য করছে, না ভালোবেসেছে। বুঝতে পারেনি নাদিয়া। অভ্যস্ততার কারণে আলাদা করে বুঝার চেষ্টা করেনি কখনো। জনি যা করেছে সেগুলো ও ভালোবাসা হিসেবেই ধরে নিয়েছে। কখনো মনের অবস্থা জানতে চায়নি। এজন্যে কি জনি অন্য কোথাও ভালোবাসা খুঁজেছে? এ সবকিছুর আড়ালে নাদিয়ার দায় লুকিয়ে নেই তো?
নাদিয়া আলী অনেক বার নিজে থেকে চলে যেতে চেয়েও থেমে গেছে। নিজের হাতে গড়া প্রতিটি জিনিস, সবই তো তার। এভাবে সে পর হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু মনে জেদ তৈরি হয়। এতদিন যেমন নাদিয়া জনির সাথে সংসার করেছে জনিও করেছে। জনি যদি সব ভুলে যায়, ও কেন পারবে না?
পরিস্থিতি একসময় অহংবোধ এ পৌঁছে যে, অবশেষে কোটেই দেখা করতে হলো।
জনির দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে নাদিয়া আলীর দু'চোখ ভরে উঠেছে। মনে মনে বলছে একবার, জনি একটিবার শুধু বলো আমি ডিভোর্স চাই না। শুধু একটিবার শুধু বলো, যা হয়েছে সব ভুলে সংসার করতে চাই। তাহলে আমি তোমার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমি আসতে চাই তোমার কাছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়েও কি বুঝো না?
উকিল নাদিয়াকে প্রশ্ন করলে নাদিয়া জনিকে জিজ্ঞাসা করতে বলে, জনি নাদিয়া আলীর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, আমি ডিভোর্স চাই।
অবশেষে জনি ও নাদিয়া আলীর বিচ্ছেদ ঘটে, বারোটা বছরের সংসারের ইতি ঘটে।
রাইটার: শারমিন সোনিয়া
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন