এটা নিয়ে বারো বারের মতো পাত্র পক্ষের সামনে বসবো আমি নিজেকে প্রদর্শন করতে। যেন আমি নারী নয়। বাজারের পণ্য। এই পণ্যটি নিয়ে দোকানের মালিকের বড় চিন্তা। পণ্য পছন্দ হলে ক্রেতা কিনবে। পছন্দ না হলে কিনবে না। চলে যাবে। যাওয়ার সময় দশটি মন্দকথা বলে যাবে। ঘটককে রাগ দেখিয়ে বলবে, তুমি একটি বাটপার মিয়া! পাঁচশো টাকা ঘুষ খেয়ে আমাদের এখানে এনেছো। বেকার সময়টি নষ্ট করেছো আমাদের! এ মেয়ের সাথে আমাদের ছেলের কোন দিকে যায়? একে বিয়ে করিয়ে নিলে তো আমাদের আলো ঝলমলে ঘরটিই আঁধারে ঢেকে যাবে!
এসব আমি মন থেকে বানিয়ে বানিয়ে বলছি না।
এর আগে দশবার এরকম হয়েছে। মা আর ভাবীরা মিলে আমায় সাজুগুজু করিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে বসিয়েছে। আর পাত্রপক্ষ আমায় রিজেক্ট করেছে। রিজেক্ট করার কারণ আছে। কারণটি হলো আমার গায়ের রং ময়লা।আপনারা যাকে কালো বলেন ওই রংটিই আমার গায়ের। আর এই জন্য অসংখ্যবার আমায় অপমানিত হতে হয়েছে। ওরা আমায় দেখে সামনাসামনিই বলেছে, পছন্দ হয়নি। মেয়ের গায়ের রং চাপা।
এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর নয়। অনেক হয়েছে। আম্মাকে সাবধান করেছি। ভাবীদের বলেছি, আরেকবার যদি আমায় এভাবে সবার সামনে বসিয়ে এরকম অপমান করা হয় তাহলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দিবো! এটি তোমাদের সাফ সাফ জানিয়ে রাখলাম।
তারপর আম্মা এক বিরাট কান্ড করলেন। নামকরা এক ঘটককে হাজার পাঁচেক টাকা ঘুষ দিয়ে বললেন,'আমার মেয়েটির একটি গতি করে দাও তো!'
ঘটক অনেক গুলি টাকা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে বললো,'আপনার আর টেনশন নাই ভাবীসাব। এই সপ্তার ভিতরেই আপনার মেয়ে পরের ঘরের বউ হইবো। ওয়াদা করলাম। আমি যদি এই কাজ করতে না পারি তাইলে আমার একটি কান আপনি নিজের হাতে কাটবেন!'
কথাগুলো বলে ঘটক তার সুপুরিতে ক্ষয়ে যাওয়া হলদেটে দাঁত বের করে হাসলো।
ঘটক চলে যাবার পর আমি আম্মার সামনে গিয়ে রাগে অভিমানে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,'আম্মা, তোমার কী একটুও খারাপ লাগে না এই যে মানুষ আমায় বার বার অপমান করে যায়? সত্যি করে বল তো আমি কি তোমার আপন মেয়ে?'
আম্মা আমায় সঙ্গে সঙ্গে জাপটে ধরেন। আম্মার চোখে জল কিলবিল করে উঠে। গলা ভিজে উঠে জলের তোড়ে। আম্মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন,'মায়ের কষ্ট তোরা বুঝবি? আমি কী শখে এমন করি রে? আমার মনে কি খুব শান্তি? তোর বাপ নাই। আমার শরীরও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কখন মরে যাই তার নাই ঠিক।আমি মরে গেলে তোর কি গতি হবে? কে তোরে দেখবে? বল?'
আম্মা কাঁদেন। আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। তার শরীর কেমন থরথর করে কাঁপতে থাকে। বুকের ভেতর থেকে নেমে আসে দরদ। আমার শরীর কেমন জুড়িয়ে দেয়।বড় শান্তি লাগে আমার!
আম্মা বলেন,'আমার মন টানছে ফারজানা। মন বলছে এইবার কিছু একটি হবে দেখিস!'
আমি কথা বলি না। আমার আর বিশ্বাস হতে চায় না। দশ দশবার প্রত্যাখান হবার পর নতুন করে এ নিয়ে আশা জাগবার কোন কারণ দেখি না।তাই আম্মার দুঃখভার মুখের দিকে, জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আমি নতুন করে নিজেকে প্রদর্শন করতে প্রস্তুত হই।
ভাবীরা কাছে এসে কানে ঝুমকো পরায়। একজন বলে কপালে একটি নীল টিপ পর। ভালো দেখাবে।
একজন বলে,হাত ভর্তি চুড়ি পর। সুন্দর দেখাবে।
একজন বলে,হলুদটি দেয়াতে ভালো হয়েছে।কালো রং ঢেকেছে।
আমার ভেতর থেকে এসব শুনে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি জানি গায়ের রং তো সৌন্দর্যের কিছু না। সৌন্দর্য থাকে মানুষের ভেতরে। কিন্তু এই সমাজের আর কেউ এসব বোঝে না কেন? সবাই বউ দেখতে এসে সবার আগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গাঁয়ের রংটিই দেখে কেন? ভেতরটি দেখতে পারে না!
চোখ থেকে টপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
মেজো ভাবী আর্তনাদ করে উঠে।
'কি সর্বনাশ! কাঁদছিস কেন তুই? মেকাপটি যে উঠে যাবে!'
ভাবী আবার মেকাপের কৌটা খুলে তুলিতে পাউডার তুলে নেয়। আবার তুলি দিয়ে ঘসতে থাকে আমার গালে।
আমার নিজেকে তখন এতো অসহায় মনে হয়! বিয়ের প্রতি আমার একেবারেই অনীহা চলে আসে। ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলি, এইসব বিয়ে টিয়ে আমি করবো না।তোমরা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাও বলছি!
কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চুপ থাকি। আম্মাকে আমি কষ্ট দিতে চাই না!
ছোট ভাবী আমার সামনে এনে আয়না মেলে ধরে। আয়নায় তাকিয়ে আমি অবাক হই। আমাকে সত্যি সত্যি সুন্দর লাগছে। কপালের টিপটি আমার চেহারায় কেমন একটি মায়া এনে দিয়েছে। নিজেকে দেখেই নিজের ভালো লাগছে। কিন্তু ওদের ভালো লাগবে তো?
পাত্রপক্ষ শহরের। ছেলের নাম ফারুক। ওমর ফারুক। নেত্রকোনা সরকারি কলেজের কেমিস্ট্রির লেকচারার। শুনলাম ছেলে আচার আচরণে খুবই ভালো।বড় নম্র- ভদ্র। কিন্তু নম্র ভদ্র হলেই বা কি! আমায় তো আর দেখে পছন্দ করবে না!
পাত্রপক্ষ আমাদের বাড়িতে আসে বিকেল বেলা। তখন সূর্যের তেজ নাই বললেই চলে। ছেলের মা আর ছেলে এসেছে। আর কেউ আসেনি।
ভাইয়া বললো,'আপনাদেরকে আগে খাবার দেই। তারপর ওকে দেখুন।'
ছেলের মা বললেন,'না না। আগে আমরা মেয়ে দেখবো। মেয়ে দেখবো আমরা উঠোনে। দেখাবার ব্যবস্থা করুন।'
ভেতর থেকে কথাটি শুনে আমার বুক কেঁপে উঠলো।এরা তো আরো শক্ত! খাবার দাবারের আগেই আমায় দেখবে। দেখে পছন্দ হবে না। তখন না খেয়েই অপমান করতে করতে চলে যাবে।
'
ওরা উঠোনে বসেছে। বড় পেয়ারা গাছটির তলে তিনটে চেয়ার পাতা ওখানে । দু' পাশের দুটো চেয়ারে ছেলে আর তার আম্মা বসেছে। আমি বসেছি ওদের সামনের চেয়ারটিতে। অদ্ভুত বিষয় হলো তিনটে চেয়ার মিলে কেমন যেন একটি মাটির চুলার মতো হয়ে গেছে! বড় ভালো লাগছে দেখতে । যেন বেশ মানিয়েছে।
আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন ওমর ফারুকের মা। ওমর ফারুক চোরা চোখে বারকয়েক তাকিয়েছে। আমি বিষয়টি ধরতে পেরেছি।
ওমর ফারুকের মা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,'কি নাম তোমার মেয়ে?'
'গুলশান আরা ফারজানা।'
'খুব মিষ্টি নাম! আচ্ছা ফারজানা, তুমি গান শুনতে পছন্দ করো?'
আমি বললাম,'জ্বি।'
'কী ধরণের গান তোমার পছন্দ?'
'রবীন্দ্র সংগীত।'
'গান গায়তে পারো?'
খানিক সময় চুপ থেকে বললাম,'জ্বি। পারি।'
মনে মনে বলছি, পছন্দ হয়নি এটি সোজাসাপ্টা বলে দিলেই তো হয়। অতো অভিনয় করবার কি প্রয়োজন আছে এখানে? আমার ইচ্ছে করছে ওদের সামনে থেকে নিজেই উঠে চলে যাই! কিন্তু কেন যেন পারছি না। বসেই আছি এখানে।
ওমর ফারুকের মা বললেন,'একটি রবীন্দ্র সংগীত গাও তো মা।'
এই এতোক্ষণে ওমর ফারুক কথা বললো। ভরাট অথচ মিষ্টি গলায় সে তাড়াহুড়ো করে বললো,'মা উনাকে বলো আয় তবে সহচরী - গানটি গায়তে।'
ওমর ফারুকের আম্মা মিষ্টি করে হেসে বললেন,'মা তুমি এই গান জানো? '
আমি বললাম,'জ্বি। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় সবগুলো গানই আমার মুখস্থ।'
ওমর ফারুক দেখি মিটিমিটি হাসছে। হাসি সে দেখাতে চায় না। কিন্তু আমি বুঝে ফেলছি সে হাসছে।
ওমর ফারুকের আম্মা বললেন,'গাও মা।'
আমি গান ধরেছি।
গান গাইতে গাইতেই দেখলাম ওমর ফারুক সাহেব আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তার পলক পরছে না আর!
গান শেষ হলে ওমরের আম্মা আমায় বললেন,'ফারজানা, তোমায় একটু জড়িয়ে ধরতে পারি আমি?'
আমি উপর থেকে নিচে মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম,'জ্বি।'
তিনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,'আলহামদুলিল্লাহ।'
এই আলহামদুলিল্লার মানে তখনও আমি বুঝিনি। তিনি এরপর বললেন,'শরবত বানাতে জানো?'
আমি বললাম,'জ্বি।'
তিনি বলেন,'ঘরে যাও তো আম্মা। শরবত করে নিয়ে আসো।'
আমি বুঝতে পারছি না আসলে কি ঘটছে। ভয়ে ভয়ে ঘরের ভেতর গেলাম। গিয়ে দু গ্লাসে লেবু- চিনির শরবত করে নিয়ে এলাম। ওমরের আম্মা ট্রে থেকে শরবতের গ্লাস উঠিয়ে এক ঢুক শরবত মুখে নিয়ে বললো,'বউমা, শরবত ভালো হয়েছে!'
ওমর ফারুক এখন আর হাসি লুকোবার কোন চেষ্টাই করছে না।সে হাসছে। তাকে সুন্দর লাগছে।
কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না কিছুই। ওমরের আম্মা যে কথাটি বললেন তা কি সত্যি সত্যিই বলেছেন নাকি আমি ভুল শুনেছি তা বুঝতে পারছি না। আমার খুব খারাপ লাগছে!
এরিমধ্যে এখানে এসে ভাবীরা উপস্থিত হলো। ভাইয়ারা এলো। আম্মা এলো। বড় মামা এলো। এদের সবার সামনে ওমরের আম্মা বললেন,'আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি আংটি পরাতে চাই আমার বউমাকে।'
সবাই বললো, 'আরে আরে কি বলে! আপত্তি থাকবে কেন? আমাদের কোন রকম আপত্তি নেই!'
কিন্তু ওমর ফারুক হুট করে বলে বসলো, 'আমার একটু আপত্তি আছে।'
শুনে ভয়ে মুষড়ে উঠলাম আমি। যা বুঝবার বুঝে গেছি। মায়ের পছন্দ হলেও এবার হয়ত ছেলের পছন্দ হয়নি । সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আম্মা, ভাইয়া, মামা আর ভাবীদের মুখেও আঁধারের ঘনঘটি নেমে এসেছে। সূর্যও তখন সবটুকু ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। আমি জানি এই সন্ধ্যা আমার মায়ের সবটুকু আশা সাঙ্গ করে দিয়ে যাবে আজ।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো ওমর ফারুক এরকম কিছুই বললো না। সে বললো,'আমরা না হয় এখানে এসে সবকিছু দেখেছি, জেনেছি। আমাদের না হয় সব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ওদের নিজেদেরও তো পছন্দ আছে। তুমি কী ফারজানাকে জিজ্ঞেস করেছো ওর পছন্দ হয়েছে কি না আমায়?'
বড় মামা ওমরের কথা শেষ হবার আগেই বললো,'মেয়ে মানুষ ওর আবার পছন্দ অপছন্দ কি! আমরা যা বলি তাই।'
ওমর ফারুক বললো, 'মামা, সংসার কিন্তু সেই করবে। বিয়েতে ছেলে মেয়ে উভয়ের পছন্দ করবার সমান অধিকার আছে।এই অধিকার ধর্মেও দিয়েছে।'
বড় মামা চুপসে গেলেন।
ওমরের মা আমার বড় ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললেন,'মা,ফারজানাকে নিয়ে ঘরে যাও তো। ওর সঙ্গে আলাপ করে এসে আমায় জানাও।'
বড় ভাবী আমার হাত ঘরে নিয়ে গেলো আমায়। গিয়ে ফিসফিস করে বললো, ' কি রে, তোর কী মত রে ফারজানা? ছেলেকে পছন্দ হয়েছে তো তোর?'
আমি বেশরমের মতো বললাম, 'হুম। খুব। খুব পছন্দ হয়ছে।'
ভাবী তখন আমার গালে চিমটি কেটে বললো,' বেলাজ মাইয়া!'
আর আমরা উভয়েই হেসে উঠলাম।
এরপর ভাবী গিয়ে ফারুকের মাকে জানিয়ে আসলো আমার পছন্দের কথা। পেয়ারা গাছের নিচের ওই চেয়ারটিতে আবার আমি বসলাম। আমার হবু শাশুড়ি আমার ডান হাতের অনামিকায় একটি আংটি পরিয়ে দিলেন। ওমর ফারুক ওপাশের চেয়ারে বসে মুচকি হাসছে। সেই হাসি চোরা চোখে তাকিয়ে দেখতে আমার খুব আনন্দ লাগছে।
লেখিকা: ফারজানা গাজি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন