নিশান চায়ের দোকানে বসে সিগারেট ফুঁকছে। রাত প্রায় এগারোটা। আকাশে অনেক মেঘ করেছে। দোকানে আর কোনো কাস্টমার নেই। দোকানদার বলল,
-- ভাইজান মনে হচ্ছে বৃষ্টি আইবো। আমি
তো দোকান বন্ধ কইরা বাড়ি যাবো গা।
অনেক রাইত হইছে। বাড়ি যাইবেন না?দোকানী অনেকক্ষণ উত্তরের আশায় দাঁড়িয়ে থাকলো। নিশান তাকে কোনো জবাব দিল না। এরই মধ্যে টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। দোকানী তার দোকান বন্ধ করে লম্বা কালো ছাতাটি হাতে নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ির দিকে এগোতে থাকলো।
নিশান হলো এই শহরের নামকরা এক মাস্তান। ছয় খুনের অপরাধে জেল খেটেছে বারো বছর। তারপরেও তাকে থামাতে পারেনি কেউ। তাকে কেউ আর জেলে আটকে রাখে এমন সাধ্য নেই। বড় বড় লোকের সঙ্গে উঠাবসা তার। টাকার বিনিময়ে সে কিলিং মিশন চালায়। সবাই তাকে একনামে চেনে। অনেক পাওয়ার তার। অথচ এই মানুষটিকে আবার কিছু মানুষ উপকারী হিসেবেও চেনে। অনায়াসে গরিব মানুষকে সে টাকা বিলিয়ে দেয়।
আর প্রায় প্রতি রাতেই তাকে মাতাল হয়ে নির্জনে বসে থাকতে দেখা যায় শহরের এ গলি ও গলির দোকানে। একা একা বিড়বিড় করে, হাসে, কাঁদে।
হঠাৎ হঠাৎ মেঘ গর্জন করে উঠছে। অনেকক্ষণ হলো সিগারেটটি জ্বলে জ্বলে আঙ্গুল বরাবর এসে ঠেকেছে নিশানের। হাতে আগুনের ফুলকি স্পর্শ করছে। সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর নেই তার। চারপাশটা ঘোর অন্ধকার। রোজ রাতের অন্ধকারে এই বি'শৃঙ্খল মানুষটি কি খুঁজে বেড়ায় তা কেউ জানে না। সারাদিন এলাকা দা'পিয়ে বেড়ায় কিন্তু দিনশেষে চুপচাপ এমন জায়গায় বসে থাকে যেখানে মানুষ নেই। হঠাৎ পাশ থেকে একটি মেয়ে কন্ঠ নিশানকে বলে উঠলো, 'একটি খুন করতে হইবো।'
নিশান মাথা না তুলেই জবাব দিল,
-- পাঁচ লাখ টাকা দিতে হইবো। হাফ ক্যাশ কাম
হওয়ার আগে আর হাফ খতমের পরে।
মেয়েটি চুপ করে ছিল দেখে নিশান আবারো বলল,
-- যে বান্দারে আউট করা লাগবো তার একখান
ছবি আর ঠিকানা দেন। ব্যাস, কাম হইয়া
যাইবো।
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ছবিটি নিশানের হাতে দিল। ছবিটি হাতে নিয়ে নিশান চোখ মুছতে মুছতে ছবিতে তাকিয়ে থমকে গেল। নিশানের কাঁপা হাত থেকে ছবিটি মাটিতে পরে গেল। মুহুর্তেই সে ছবিটি তুলে গায়ের গেঞ্জি দিয়ে মুছল। তারপর মেয়েটির দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-- খুশি?
উত্তরে মেয়েটি বলল,
-- হ আমি, খুশি। পারবি আমারে খুন করতে?
এবার আমারে চিরজীবনের লাইগা মুক্তি দে।
নিশান হু হু করে কেঁদে উঠে বলল,
-- পারমু না। হেইডা আমি কোনদিন পারমু না।
খুশি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তারপরে বলল,
-- ক্যান তুই তো এ শহরের ম্যালা বড় মা'স্তান।
কত খু'ন করিস, গু'ম করিস, ভাঙচুর
করিস, মাতলামি করিস। এগুলা তো তোর
খেলা। মাইরা ফ্যাল না আমারে তোর মন
থাইকা। কত ট্যাকা লাগবো তোর ক আমারে।
নিশান কেঁদেই চলেছে আর বলছে,
-- তুই জানোস না আমি এগুলা ক্যান করি? ওরা
তোরে আমার থাইকা কাইড়া নিছে রে। আমার
জীবনডা শেষ কইরা ফ্যালাইছে। তাই আমি
কাউরে ছাড় দেই নাই। আমি সবগুলারে শেষ
কইরা ফ্যালাইছি। আমি স....ব শেষ কইরা
দিছি।
খুশি বলল,
-- আমি এই নিশানরে ভালোবাসতাম না।
কোনদিনই না। আমি ওই ছেলেডারে
ভালোবাসতাম যার লগে আমি বস্তিতে বড়
হইছি, খেলছি, হাসছি, কানছি, একলগে
খাইছি। রোজ গার্মেন্টসে কামে যাইতাম।
সন্ধ্যায় ফেরত আইবার সময় করিম চাচার
দোকানে পুরি সিঙারা খাইতাম। ওড়না দিয়া
ওর ঘাম মুইছা দিতাম। ওই ছেলেডা খুব ভীতু
ছিল। ওর দয়ার শরীর ছিল। হে নিজে কষ্ট
কইরা কত রাস্তার পোলাপান, কুত্তা বিলাইরে
খাওয়াইছে। আইজ সে মাইনষের র'ক্ত চু'ইষা
খায়। এরে আমি ভালোবাসি নাই।
নিশান খুশির ভুল ভাঙাবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে বলল,
-- না না। তুই ভুল বুঝতাছোস। আমি ওহনো ওই
বস্তির পোলাদের টাকা দিয়া আসি। ম্যালা
টাকা দিই। কুত্তা বিলাইরে আমার পাতের
ভাত খাওয়াই। আমার তো খাবার পেটে সয়
না। খাইতে বসলে তোর রক্ত'মাখা দেহখান
মুখের সামনে ভাইসা উঠে। বমি উইঠা যায়।
আমি তোরে বাঁচাইতে পারি নাই রে খুশি।
বলে নিশান চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। খুশি বলল,
-- হ টাকা তো দেস। হারামের টাকা।
-- আমি কিন্তু ভালো লোকেরে মারি না। যাদের
বাঁইচা থাকবার অধিকার নাই ওগোরে মারি।
এলাকাগুলার ময়লা লোক পরিষ্কার হয়।
-- ভালো খারাপের বিচার করার তুই আমি
কেডা। ওপরে একজন বইসা আছে না। সব
তার ওপরে ছাইড়া দিতে হয়।
নিশান খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপরে অভিমানের সুরে বলল,
-- এতোদিন পরে আইলি ক্যান? তোরে কত
খুঁইজা বেড়াই রোজ জানোস না?
খুশি মুখ ঘুরিয়ে বলল,
-- ঘিন্না হয় তোর ওপরে। আইজ কিন্তু শেষবার
আইছি। আইজ যদি আমার কথা না শুনিস
তাইলে আর কোনদিন আমারে দেখতে পাইবি
না।
নিশান খুশির হাতটি ধরে বলল,
-- না না, এইসব কইস না। তোরে না দেইখা আমি
থাকতে পারমু না। আমি মইরা যামু।
খুশি বলল,
-- তাইলে নিজেকে ক্ষমা কইরা দে আইজ। তোর
কোন দোষ আছিল না। ওই জানো'য়ার গুলা
আমারে ছিঁ'ইড়া খাইতে চাইছিল। জানোস,
আমি ম্যালা চেষ্টা করছিলাম। অনেক
চিল্লাইছি, কানছি, পা ধরছি। ছাড়ে নাই। পরে
আমার গলাডা দিল কাই'ট্টা। ভালোই হইছে।
তোরে ক্যামনে মুখ দেখাইতাম।
নিশান ধমকে বলল,
-- চুপ। একদম চুপ। তোরে আমি ভালোবাসতাম।
তোর যাই হয়ে যাক তোরে আমি ঘিন্না করতাম
না রে কোনদিন। শুধু তুই একটাবার আমার
লগে থাকতি।
খুশির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গেল। তারপরেও সে ওড়না দিয়ে নিশানের চোখের পানি মুছে দিল। বলল,
-- আমার কথা মন দিয়া শুন। আইজকার
পর যদি তুই কোন মাইনষেরে আ'ঘাত করোস
তার আগে তোর আমারে খুন করতে হইবো।
আর যদি আমারে খুন করতে না পারোস
তাইলে আবার আমার আগের নিশান হইয়া
যা। তোরে ভালোবাসবার মন চাই। ফ্যিইরা
আয় আমাগো সেই বস্তিতে। যেইখানে আমি
আর তুই এক ছিলাম।
কথাটি শুনে নিশান চুপ করে গেল। খুশি নিশানের হাত নিজের মাথায় তুলে বলল,
-- আমার মাথার কসম খা। তুই আর কোন
আজেবাজে কাম করবি না।
নিশান কেঁদে বলল,
-- কসম, আর করমু না। কিন্তু তুই আমারে
ছাইড়া যাইস না। আরেকবার ভালোবাস
আমারে। ঘিন্না করিস না।
খুশি মুচকি হেসে বলল,
-- ভালোবাসি, শুধুই তোরে। রোজ আমাগোর
দেখা হইবো। কোথায় আমারে পাইবি তুই
ভালো জানোস।
বলে খুশি নিশানের কপালে একটি চুমু দিয়ে ক্ষণিকেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আজ পাঁচ বছর। নিশান ফিরে এসেছে নিজেদের পুরোনো বস্তিতে। নিশান নামের মাস্তানটা ভালো হয়ে গেছে। কাউকে খুন করার পরিকল্পনা মাথায় নেই, কোন ছাই পাশ খাবার অভ্যাস নেই। বস্তিতে চাঁদা'বাজির, মারপিটের অভিযোগ নেই। এখন সে নিয়মিত গার্মেন্টসে কাজে যায় ঠিক যেভাবে ষোলো বছর বয়সী এক যুবক কাজে যেত। রোজ সন্ধ্যায় সে তার ভালোবাসার মানুষ খুশির সাথে বাড়ি ফিরতো। বিয়ে ঠিক হয়েছিল ওদের। বিয়ের কয়েকদিন আগে এক রাতে খুশিকে একদল নরপশু হত্যা করে। তারপর থেকেই প্রতি'শোধের টানে সহজ সরল যুবকটা হয়ে যায় এলাকার নামকরা মাস্তান।
তবে আজও নিশানের মনে খুশির ভালোবাসার টান আছে। সে কখনো চায়নি খুশিকে হারাতে। তাই সে সবকিছু ছেড়ে আবারো পুরোনো নিশান হয়েছে। এখন সে হালাল উপার্জন করে। বেশিরভাগ রাতে সে এতিমখানায় কর্মী হিসেবে কাজ করে। আর সেখানেই থেকে যায়। অসহায় মানুষদের সাহায্য করে।
এখনও রোজ সন্ধ্যায় নিশান কল্পনার খুশির হাত ধরে বাড়ি ফেরে, দুজনে গল্প করে, হাসে, কাঁদে। শুধুমাত্র একটিই ভয় নিশানের, বাস্তবের মানুষটিতো মাটিতে মিলিয়ে গেছে সেই কবেই। কল্পনার মানুষটির ভালোবাসা যেন হারিয়ে না যায়।
(সমাপ্তি)
লেখক: নূর-এ সাবা জান্নাত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন