বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০২২

গল্প: বৃদ্ধা

শহর থেকে বাড়িতে আসার সময় বাস না পেয়ে লেগুনায় উঠলাম। লেগুনাটি মানুষ দিয়ে ভর্তি ছিলো তার মাঝে অল্প একটু জায়গায় নিজেকে গুটিশুটি করে বসে মানিয়ে নিলাম।  আকাশটি মেঘে ছেয়ে আছে আর যেকোনো সময় প্রবল বৃষ্টি নামতে পারে। হঠাৎই পাশে কাপা কাঁপা কন্ঠে কেউ বললো- এদিকে আর একটু চেপে বসো নয়তো পড়ে যাবে।  

এবার আমি পাশে তাকালাম। একজন বৃদ্ধ মহিলা বয়স ষাটের কিছু বেশি হবে মনে হচ্ছে। তাড়াহুড়ায় আমি কার পাশে এসে বসলাম সেটা দেখারও সময় পাইনি।  

- ওহ দুঃখিত আমি তাড়াহুড়ো করে মহিলাদের সিটে এসে বসছি।  

- সমস্যা নাই। আর তুমি তো আমার নাতির মতোই ।  

- ধন্যবাদ দাদী।  কোথায় গেছিলেন আপনি?

- আমি একটু ডাক্তারের কাছে গেছলাম।

- আপনার সাথে কেউ আসেনি?  

- আমার ছেলেরা সবাই পড়ালেখা শেষ করে এখন ঢাকায় চাকরি করে আর তোমার দাদু মারা গেছে আজ বছর পাঁচেক।  

- ওহ আচ্ছা ।  

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হঠাৎই দাদী জিজ্ঞেস করলো- গাড়ি এখন কোন জায়গায়?  

- আপনি কোথায় নামবেন?  

- আমি তো শঠিবাড়ি নামবো।  

- ও আচ্ছা। এখনো দেরী আছে  আমরা মাত্র মিঠাপুকুরে আসছি।  

আমার কথাটি শেষ হতে না হতেই সেই বৃদ্ধা চিৎকার করতে লাগলো - গাড়ি ঘুরাও গাড়ি ঘুরাও।  আমায় জায়গীর এ নিয়ে যাও।  

ড্রাইভার যখন তার কথায় কান দিলো না তখন সে জোরে জোরে কান্না করতে শুরু করলো আর বলতে লাগলো আমায় জায়গীরে নিয়ে যাও।   তার এই কান্না দেখে আমার অনেকটা ভয় হতে লাগলো।  হয়তো জায়গীরে খুব প্রয়োজনীয় কিছু ভুলে ফেলে আসছে। 

ড্রাইভার এবার গাড়ি থামালো। কিন্তু এতগুলি যাত্রীদের নিয়ে গাড়ি আবার ঘুরিয়ে জায়গীর নিয়ে আসা সম্ভব নয়।  

কিন্তু সেই বৃদ্ধা কিছুতেই রাজি নয় তাকে জায়গীরের নিয়ে যেতেই হবে ।  

ড্রাইভারের মুখ শুকিয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম যে ইচ্ছা থাকলেও বেচারার উপায় নেই।  কারণ এত্তগুলা যাত্রী সবার কথাই তো তাকে ভাবতে হবে।

কোনো উপায় না দেখে আমি তখন বৃদ্ধাকে নিয়ে লেগুনা থেকে নেমে একটি অটোতে করে জায়গীরে চলে আসলাম। আমরা বাঙালি আমাদের বেশির ভাগ সম্পর্ক রাস্তায় গড়ে ওঠে।  এটিও তে একটি সম্পর্ক তিনি আমায় নাতি বলেছে ।  

বেশ কিছু সময় পরে আমরা জায়গীর এসে পৌছালাম।

- দাদী আমরা জায়গীর আসছি এখনে আপনার কি কাজ আছে বলুন আমি করে দিচ্ছি। 

সেই বৃদ্ধার চোখে তখনও পানি লেগেই আছে ।  আমার কথা শুনে চোখ মুছে তার ব্যাগ থেকে একটি ঔষধ আর পানির বোতল বের করে ঔষধটি খেয়ে বললো- কাজ হয়ে গেছে এখন চলো।  

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।  

- আপনি তো কিছুই করলেন না তো কাজ কিভাবে হয়ে গেলো! 

- আমি যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম সে সম্পর্কে আমার ভাগ্নে হয়।  এই ঔষধটি খাওয়ার প্রায় ত্রিশ মিনিট পরে অন্য সব ঔষধ খেতে হবে নয়তো সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমি তো সময় ঠিক মতো চিনি না তাই জন্য ভাগ্নে বলে দিছে যখন গাড়ি জায়গীরে যাবে তখন এই ঔষধটি খেতে নিতে তাহলে বাড়ি যেতে যেতে ত্রিশ মিনিট হয়ে যাবে তখন অন্য ঔষধ গুলো খেলে আর কোনো অসুবিধা হবে না।  তুমি অনেক ভালো নাতি তোমার জন্য আমি সঠিক জায়গায় ঔষধটি খেতে পারলাম নয়তো কি যে সমস্যা হতো।  অনেক দিন বেঁচে থাকো তুমি।  

আমি তো পুরাই থ হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তার কথা শুনতে লাগলাম বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না।  আজ নিজেই নিজেকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলতে ইচ্ছে করছে পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে ।  বেঁচে থাকো তুমি দীর্ঘজীবী হও, সদা সর্বদা কারণ না জেনে অন্যের উপকারে এমন ভাবে এগিয়ে যাও। 


লিখা: Sumon Al-Farabi

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন