বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২২

গল্প: বিয়ে ভাঙা

 'বিয়েটা হবে না।'

রুবেল বললো। শুধু এটুকু নয়, সাথে আরেকটা কথাও বললো।

'কালো মেয়েকে কোনদিন আমি বিয়ে করবো না। মরে গেলেও না। আমার আব্বু টাকার লোভে এটি করতে চেয়েছিল। দুঃখিত, আপনার কাছে মাফ চাইছি আমি। প্লিজ কষ্ট নিবেন না মনে।রাখি বাই।'

তারপর আমি কোন টু শব্দটি করার আগেই অপর পাশ থেকে লাইনটা কেটে দিলো রুবেল। আমি কোন কথা বলার সুযোগই পেলাম না। আমার মাথা প্রচন্ড রকম খারাপ হয়ে গেল। পায়ের নিচের মাটি কেমন সরে যেতে লাগলো দূরে। হৃৎপিণ্ডের কাঁপুনিতে আমার হাত পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। তখন হাত থেকে ঝট করে মোবাইলটি ছিটকে পড়লো ফ্লোরে। তখনও আমার হাতে আংটি আছে। জানলার ফাঁক গলে ভোর সকালের আলো পড়ে সেই হেম রঙা আংটি চিকচিক করে জ্বলছে।ফ্লোরে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনের দিকে না তাকিয়ে আমি তাকালাম আংটিখানার দিকে। এই আংটিখানা ওরা দিয়ে গিয়েছিল গত সপ্তাহে।মহা সমারোহে বাড়িতে আয়োজন করে দশজন মেহমানকে খাওয়ানো হলো। তারপর আমার হবু শশুর বিয়ে ঠিক করে গেলেন। শাশুড়ি আমার হাতে এই আংটিখানা পরিয়ে দিয়ে বললেন,'লক্ষ্মী মেয়ে আমার!'

রুবেলের সাথেও সেদিন কথা হয়েছিলো আমার। বাড়ির মুরুব্বিরা পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিলেন আমাদের কথা বলার জন্য। আমরা ছাদে গিয়ে কথা বলেছিলাম। রুবেলকে আমার পছন্দ হয়েছিল।ও দেখতে ভালো।কর্মও ভালো। কিন্তু আমার গায়ের রং যে কালো! যদিও গায়ের রং নিয়ে হীনমন্যতায় থাকা সংকীর্ণ মনের পরিচায়ক।রং গায়ের হয় না।রংয়ের প্রকারভেদ হয় মনের।

আমি বলেছিলাম,'আপনি একটু ভালো করে ভাবুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন।'

রুবেল গাঢ় হেসে বলেছিলো,'বাবা মার উপর আমার আর কোনো কথা নেই। তাদের পছন্দই আমার সই।'

সেদিন এসব বলে আজ যখন বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিকঠাক, আত্মীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী সকলকে দাওয়াত করা হয়ে গেলো তখন এমন একটি সংবাদ কেন দিলো রুবেল?

হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। দম কেমন আটকে যেতে লাগলো। আম্মা উঠোনে মরিচ শুকোতে দিয়েছেন। আব্বা বারান্দায় বসে রবিনকে অংক পড়াচ্ছেন। আমি কী এখন এই কথাটি তাদের কাছে বলবো গিয়ে?

বলতে পারলাম না আমি। এমন কথা যে খুব লজ্জার হয়!একটি মেয়ের হুটহাট বিয়ে ভেঙে গেল আর সে গিয়ে তার বাবা মাকে ডেকে বলছে,বাবা,মা, আমার বিয়েটি ভেঙ্গে গেছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

লজ্জা এবং ঘৃণায় চোখ ফেটে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো আমার গালের উপর। আমি সেই জল আটকাতে পারলাম না কিছুতেই। গাল বেয়ে ছল ছল করে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো নিচে।

বিছানার উপর বসে চাপা স্বরে কাঁদতে থাকলাম আমি।বড় নিরবে।বড় নিভৃতে। ঠিক তখন হঠাৎ করে মনে হলো, আচ্ছা,আমি শুধু শুধু এমন করছি কেন? রুবেল আমার সাথে মজাও তো করতে পারে! 

আমি ফ্লোর থেকে ফোনটি উঠিয়ে নিয়ে কল করলাম রুবেলকে। এবার আর রুবেল ফোন ধরলো না।ফোন ধরলো তার মা।বললো,'মাগো, ভুল হয়ে গেছে আমাদের। আমাদের ছেলে তোমাকে পছন্দ করেনি। তাছাড়া আমরাও সেদিন তোমায় খুব ভালো করে দেখতে পারিনি। আমার একটি মাত্র ছেলে। বুঝোই তো মা। ওর পছন্দের গুরুত্ব না দিলে তো আর সংসার টিকবে না। সংসার তো ও করবে আমরা না। তাছাড়া তুমি যদি শুধু আরেকটু ফর্সা হতে তবুও ভাবা যেতো। আমাদের ক্ষমা করো মা। আমাদের ভুল হয়ে গেছে।'

এবার আর ওপাশ থেকে কেউ ফোনকল কাটলো না। কাটলাম আমি নিজেই। ততক্ষণে আমার কান্নার গলা অনেকটাই বেড়ে গেছে। আব্বা এবং আম্মা এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন আমার। আম্মা বললেন,'কী হয়ছে বৃষ্টি,কী হয়ছে  আমার মায়ের? কী হয়ছে তোমার আম্মা?'

আব্বাও এসে বসেছেন পাশে।জানতে চেয়েছেন তিনিও। আমি কথা বলতে পারি না কান্নার দাপটে। লজ্জায় কেমন মরে যেতে ইচ্ছে হয় হঠাৎ। আম্মার হাতে ফোনটি তুলে দেই আমি। আম্মা কল করেন রুবেলদের বাড়ি।আব্বাও কথা বলেন।গালাগালি হয়ে যায় একছুট দু পাশ থেকেই। কিন্তু তাতে কী? বিয়ে তো আর হবেই না এটি।ওরা রাজি হলেও আব্বা ওখানে আমায় বিয়ে দিবেন না। প্রায় হয়ে যাওয়া একটি বিয়ে হুট করেই এভাবে ভেঙে গেল।


এইসব খবর চাপা থাকে না। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে।লতার মতো। উড়ে যাওয়া পাতার মতো। আমার এই অপমানের খবরটিও ছড়িয়ে যেতে দেরি হয়নি। মানুষের মুখে মুখে তখন শুধু আমার নামই খৈয়ের মতন ফুটতে থাকে।তারা একে অপরের কানে বাড়িয়েও কতো কথা বলে! ওইসব কথা আবার আমার কানেও আসে। তখন প্রচন্ড মন খারাপ লাগে আমার।দুনিয়াটা কেমন যেন দোযখের মতো মনে হয়। স্বচ্ছ আয়নার ভেতর তাকাই আমি। তাকিয়ে আমার এই বিকৃত চেহারা এবং গায়ের রংটিকে খুব ভালো করে পরখ করে দেখি। তারপর বড় উপহাস করতে থাকি নিজেকে নিয়ে।মরে যেতে ইচ্ছে করে হঠাৎ আমার। কিন্তু মরে যাইনি আমি। আম্মা কাছে এসে সান্ত্বনা দেন। বলেন ধৈর্য ধরতে। ধৈর্যের ফল নাকি শুভ হয়। তিনি বলেছিলেন সুন্দর্য্য কী মা সাদা চামরায় থাকে?আমরা সুন্দর্য্য চিনিই না। তুমি ধৈর্য্য ধরো মা। তোমার জন্য এমন মানুষ আসবে যার চোখ সুন্দর্য্য চিনে।ধৈর্য্যই ধরেছিলাম আমি। ধৈর্যের ফল আমার খারাপ হয়নি। গাঁয়ের মানুষ ভেবেছিলো গায়ের রং আর ওই অপমানের জন্য আব্বা- আম্মা আমায় আর বিয়ে দিতে পারবেন না কখনো। কিন্তু কপালে ভালো কিছু থাকলে তা কী করে কেউ ফেরাতে পারবে? এবার আমার বিয়ে হয়ে গেলো রুবেলর চেয়েও অনেক বেশি ফর্সা এবং যোগ‍্যবান ছেলের সাথে। যদিও আমি ফর্সা কোন ছেলেকেই বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু নজরুল নামের ওই ছেলেটি আমার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। কেন লেগেছিল আমি তখন জানতাম না। কিন্তু বিয়ের পর জেনেছি সে নাকি মানুষের কাছে আমার গুণের কথা শুনেছিলো।গুণ বলতে এটুকুই আমি ভালো গান জানি। মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে পারি ভৌতিক গল্প বলে। তার নাকি ঠিক এমন মেয়েই চায়। রাতভর তাকে গান শুনাবে এবং ভৌতিক গল্প বলে ভয় পাইয়ে দিবে। এটুকুই! আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মানুষ বড় অবাক হয়ে গেল। কিন্তু আমি খুব একটা অবাক হইনি এতে। আমি বিশ্বাস করতাম বাস্তবতার চেয়েও বেশি কপালের লিখনিকে।তাই অবাক হয়ে যাওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাইনি আমি।

নজরুলের সঙ্গে খুব ভালো সময়ই কাটছিলো আমার। অসম্ভব ভালো মনের মানুষ সে।গান গেয়ে কতবার তাকে মুগ্ধ করেছি আমি আর কতরাতে যে ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি ভৌতিক গল্প বলে তার কী আর হিসেব আছে! এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিল আমাদের।

একদিন হঠাৎ করে নজরুলকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম ওর এক অসুস্থ খালাকে দেখতে। খালার অপারেশন হয়েছিল।হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসার সময় হাসপিটালের গেটে হঠাৎ একটি মুখ দেখে থমকে দাঁড়ালাম আমি। লোকটিকে আমি খুব ভালো করে চিনি।ওর কোলে একটি দু'তিন বছরের বাচ্চা। মেয়ে বাচ্চা। গায়ের রং কালো। আমার চেয়েও বেশি কালো। বাচ্চাটি কার আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাটি রুবেলকে ডেকে উঠলো,'পাপ্পা,পাপ্পা।'

ততক্ষণে আমি খুব ভালো করে বুঝে গেছি এই মেয়ে রুবেলেরই। আমার খুব কষ্ট লাগলো হঠাৎ এই ভেবে যে রুবেলের এই কালো মেয়েটিও কী আমার মতো এমন পরিস্থিতির শিকার হবে না একদিন? তারও কী কোনদিন এই গায়ের কালো রংটির জন্য বিয়ে ভেঙে যেতে পারে না? আচ্ছা তখন কী রুবেলের একটুও কষ্ট হবে না? রুবেলের কী মনে পড়বে না সেও এমন করে শুধু গায়ের রংয়ের জন‍্যই একটি মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলো? অপমান করেছিল?তার কী সেদিন খুব অপমান হবে না?

ভাবলাম আমি। ভাবলাম, গায়ের রং ছেড়ে কখন মানুষ মানুষের ভেতর টুকু দেখতে শুরু করবে। কখন পৃথিবীর সকল মানুষেরা রুবেল থেকে নজরুল হয়ে উঠবে!


রাইটার: শফিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন