হাতে পায়ে কালি মেখে আমি পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছি। উদ্দেশ্য ছিল বিয়েটা হওয়ার আগেই আছাড় মেরে ভেঙে দেয়া। কাল রাতে যখন নাইমা খালা ফোন করে জানালেন, আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। সেইসময়ই আমি জোড়েসোড়ে বলে উঠি, "না, আমি এখন বিয়ে করবো না।" আমার মাও স্থান, কাল, পাত্র ভেদে হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, "ভীষণ বেয়াদব হয়েছো তুমি পারভিন। বড়দের মুখে মুখে তর্ক করো।" আমি আমার ছাত্রদের সামনে লজ্জায় মাথাটা নিচু করে বসেছিলাম।নাদিয়া আর জনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো। এটি কী করলো মা? এখন কী আমি ওদেরকে আর ধমক দিতে পারবো। এমনিই আমি কখনো ওদের শাসন করতে পারি না। সে যাই হোক ছাত্রদের ছুটি দিয়ে রুমে এসে দরজা বন্ধ করলাম। তারপর মোবাইলে কল লাগালাম কলিজার বান্ধবী রোকেয়াকে।
যার এ যাবতকাল পর্যন্ত ত্রিশটা বিয়ে ফেরানোর অভিজ্ঞতা আছে। সেই আমাকে এই নিঞ্জা পদ্ধতিটি শিখিয়ে দিলো। রোকেয়া আমাকে অভিজ্ঞদের মতো বলেছিলো,"তুই যে ফকফকা সুন্দরী তা আজকে আর অস্বীকার করবো না। তোকে দেখলেই যেকোনো ছেলে কেন ছেলের আব্বারও পচ্ছন্দ করবে। তাই কাল যে রাজপুত্রই আসুক না কেনো তোকে পছন্দ না করে ফিরবেই না।"
আমি ভূমিকম্প ধরানো গলায় বলেছিলাম,
"তাহলে এখন আমার কী হবে রে রুকু? আমিতো এখন বিয়ে সাদী করে রান্নাঘরে বন্দী হতে চাই না।তুইতো জানিস আমি রান্না করতে গেলে খাবার আর খাবার থাকে না। ওটি অন্য কিছু হয়ে যায়।"
"বইন তোর ওই কুখাদ্যদের কথা মনে করে আমার বমির থেরাপিটা শুরু করে দিস না। এখন শুন, আমি যা বলি তা তুই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি।"
"হু বল।"
আমার সম্মতি পেতেই রোকেয়া তার বিজ্ঞ পরামর্শ দেয়। "তুই সুন্দর সেটি সকলেই জানে। তাই সেটা লুকানোর উপায় নাই। কাল পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে নিশ্চয়ই পাত্র একা আসবে না। সঙ্গে মা-বোন কিংবা ভাবি আসবে। তাই এক কাজ করবি তোর মুখে ভারী মেকআপ করে চমলক্ষ সুন্দরী হয়ে থাকবি। আর হাতে পায়ে মাখবি কালি। ছেলেকে সুযোগ দিক আর না দিক মা-বোন তোকে ভালো করতে দেখতে তোর রুমে আসবেই। আমি ত্রিশটা বিয়ের পাত্রী হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তারা তোর মুখের চেয়ে তোর হাত-পায়ের দিকে তাকাবে বেশি। তারা যখন দেখতে পাবে যে তোর মুখ ফর্সা হাত-পা কালো। তখন তোকে আর কিছু করতে হবে না তারাই তোকে রিজেক্ট করে দিবে।"
আমি তো আমার বান্ধবীর বুদ্ধি শুনে পুরাই ফিদা। খুশির ঠেলায় আমি তাকে তিন চারটি ধন্যবাদ আর আট-দশটা ভার্চুয়াল চুমু দিয়ে দিলাম। তারপর ফোন কেটে আত্মবিশ্বাসের সাথে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সকাল পাত্রপক্ষ আসার তোড়জোড় শুরু হলো। সবাই আমাকে অসুস্থ রোগীর মতো যত্ন করা শুরু করে দিলো। যেনো আমাকে মাটিতে রাখলে পিপড়া কামড়াবে আর মাথায় রাখলে উকুনে কামড়াবে। নিজের পরিবারের এমন ভালোবাসা দেখে আমি আবেগের কয়েক ফোটা জলও ফেললাম।সন্ধ্যার দিকে তাদের আসার কথা রয়েছে। মা-চাচীরা আমাকে শাড়ি পরে রেডি হওয়ার আদেশ দিলেন। আমি শাড়ি শব্দটিতেই অনীহা ছুড়লাম। তবে বেশিক্ষণ অনীহাতে অটল থাকতে পারলাম না। দাদীর রওশন জামিলের মতো চেহারা দেখে শেষ পর্যন্ত আমি শাড়ি পড়েই নিলাম। রোকেয়ার কথামতো চমলক্ষ সাজে নিজেকে সজ্জিত করে নিলাম। সবাই আমাকে মাশা-আল্লাহ বলে চলে যেতেই স্বযত্নে লুকায়িত কালির ডাব্বাটা বের করে হাতে পায়, হালকা গলায় এবং কোমরে কালি মেখে নিলাম। এখন আমি পুরাই রেডি।
বর্তমানে যথানিয়মে পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছি। রোকেয়ার অভিজ্ঞতা একশো ভাগ সঠিক প্রমাণ হলো। পাত্র আমার দিকে লজ্জায় তাকাতে না পারলেও, তার মা আমাকে গিলে খাচ্ছে। এভাবেও যে কোনো মেয়ে কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে পারে আজকের পরিস্থিতিতে না পরলে আমি বুঝতাম না।নাইমা খালা ঘটকালি ঐতিহ্য ধরে রাখতে তিনি আমার প্রশংসা বিরামহীন করেই যাচ্ছেন। নাইমা খালার মুখে আমার ভালো বৈশিষ্ট্যের পসরা শুনতে শুনতে এখন আমার নিজেকেই চিনতেই অসুবিধে হচ্ছে। আমি আসলেই এতো ভালো! কই এমন আগে তো কেউ বলে নি। রোকেয়ার কথামতো পাত্রের মা আমাকে নিয়ে আমার রুম দেখার বাহানায় উঠে এলেন। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, "মা, তোমার নাম কী?"
আশ্চর্য মহিলা নাম জানে তবু জিজ্ঞেস করছে।আমি মিনমিন কণ্ঠে বললাম, "জ্বী পারভিন আক্তার।"
"তুমি পড়ালেখা কতদূর করেছো?"
"এইবার ডিগ্রী ফাইনাল ইয়ারে।"
উনি আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবার আমাকে কুনজরে দেখে কুপ্রস্তাব দিলেন,"মা, তোমার হাতটি দেখি?"
আমি সংশয় নিয়ে বদ্ধঘরে আমার হাতটা এগিয়ে দিলাম এই আশায়, যে রোকেয়ার মুখে শুনেছি পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে মেয়ে পছন্দ হোক না হোক কিছু বখশিশ সোজা ভাষায় সেলামি দিয়ে যায়। আমি হাতটি দিতেই তিনি তা শক্ত করে ধরলেন এবং ঘষতে শুরু করে দিলেন। আমার ব্রান্ডের কাজলের কালি আমার শরীরের সাথে খুবই ভালো ভাবে মিশে গেছে। তিনি ঘষতেই সেগুলো একটু একটু করে উঠতে লাগলো। এগুলো কালো কালি হলেও দেখতে মাটি মনে হচ্ছিলো। উনি কতক্ষণ হাতের যে জায়গায় ঘষেছিলেন এখন সে ফর্সা স্থান আমার লাল হয়ে গেছে। তিনি এবার আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা তারপর বাহিরে গিয়ে যা বললেন তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি জানালেন যে, তিনি কোনো নোংরা অপরিষ্কার মেয়েকে নিজের ঘরের বউ বানাতে চান না। যে মেয়ে ঠিকমতো নিজের শরীরই পরিষ্কার রাখতে পারবে না, সে মেয়ে তার ঘর পরিষ্কার রাখবে কী। আর তিনি যাওয়ার সময় আমার আম্মাকে আমাকে গোসল করিয়ে দেওয়ার সুপরামর্শ দিয়ে গেলেন। যার বদৌলতে এখন আমি এক ঘন্টা ধরে গোসলঘরে আটকে আছি। আর আমার শরীরকে রান্না ঘরের থালাবাসনের মতো ঘষে যাচ্ছেন আমার মা-চাচীরা। আমি কালো হতে গিয়ে এখন লাল হয়ে যাচ্ছি। এর থেকে বিয়েটি হয়ে গেলেই ভালো হতো।সবার আহ্লাদে গদগদ থাকতাম। কদিন গেলে হলুদ দিয়ে গোসল করতাম এভাবে ভীম দিয়ে নয়। এটি কী করলাম আমি? পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে সবাই পায় সেলামি আর আমি পেলাম আক্কেল সেলামি।
লিখেছে: JannatTaslima
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন