তাসনুভাকে এভাবে কান্না করতে দেখে আরিয়ান সব ভুলে বেডে উঠে ওর সামনে গিয়ে শুয়ে পড়ে। তাসনুভা হঠাৎ করে মাঝ রাতে আরিয়ানকে দেখে চমকে যায়। ও কিছু বলার আগেই আরিয়ান ওর চোখদুটো মুছে দেয়। তাসনুভা ডিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আরিয়ানের চোখেও পানি। আরিয়ান তাসনুভার চোখ মুছে দিয়ে ওকে টান দিয়ে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। আজ কেন জানি আরিয়ানের বুকে তাসনুভা একটু শান্তি খুঁজে পাচ্ছে৷ তবে ওর খুব কান্না পাচ্ছে আর অনেক ভয় লাগছে৷
আরিয়ান ওর মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
- নাতাশার জন্য নিজেকে দোষারোপ করো না৷ আর ভয়ও পেয়ে না৷ আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার কিছু হতে দিব না তোমার বাবাকে আমি কথা দিয়েছি। আমি আছি তো। আমার শেষ সম্বল তুমি। এত সহজে তোমাকে আমি হারাতে দিব না৷ যদি হারিয়ে যাও আমাকেও সাথে নিয়ে যেও।
তাসনুভা আরিয়ানের বুকে মাথা লুকিয়ে ওর কথা গুলো শুনছিল। মেয়েটি নিঃশব্দে কাঁদছে আর ভাবছে, ওর মনের কথা গুলো আরিয়ান কিভাবে বুঝলো। আর কেনই বা আজ আরিয়ানের বুকে ওর নিজেকে সেইফ মনে হচ্ছে৷ তাসনুভা আরো ভাবে, এই আরিয়ানকে ও কত যা তা বলেছে, কিন্তু আজ ওকে বাঁচাতে আরিয়ান নিজের জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিচ্ছে। কিন্তু কেন? কি এমন আছে ওর মধ্যে যে নাতাশা পর্যন্ত তার জীবন দিয়ে দিল। তাসনুভা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে,
~ আমার কি মনে হয় জানেন, আমাকে তখন মরে যেতে দিলেই অনেক ভালো হত। না নাতাশা আপু হারাতো না আপনাকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হত।
আরিয়ান তাসনুভার মুখখানা বের করে ওর কান্নাসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
- আচ্ছা তুমি কি বোকা? তুমি বুঝেও কি বুঝতে চাও না? আমি তোমাকে ভালবাসি। সেদিন প্রথম যখন তোমার সাথে নাচতে ছিলাম তখন পুরোটি সময় তোমার এই চোখের দিকে আমি তাকিয়ে ছিলাম। তোমার এই চোখের মাঝে আমি তোমাকে পড়ে ফেলেছিলাম। একটি নিষ্পাপ, কোমল, মায়াবী মেয়ে আমি সেদিন দেখেছি এই চোখের মাঝে। যার বিয়ে হচ্ছিল একটি লোভী ছেলের সাথে। আমি এতটা অধম না যে কারো বিয়ে ভেঙে দিব৷ তোমার মতো এত ভালো একটি মেয়ে কখনোই ওর হতে পারে না। তাই তোমাকে আমি ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। ভালবাসি তোমাকে। অনেক বেশি ভালবাসি। আর তোমার প্রতি এই ভালবাসাটি নাতাশা আমার চোখে দেখেছে। তাই ও জীবন দিয়েও আমার একমাত্র ভালবাসাকে ও বাঁচিয়েছে৷
আরিয়ানের মনের কথাগুলো শুনে তাসনুভা অঝোরে কাদঁছে। ও ভাবতেও পারি আরিয়ান ওকে এতটা ভালবাসে। আরিয়ান সেই প্রথম থেকেই ওকে বাঁচিয়ে আসছে৷ আর বিনিময়ে ওর কাছ থেকে পাচ্ছে তুচ্ছ আচরণ। তাসনুভার খুব খারাপ লাগছে৷ ও কষ্টে আর লজ্জায় চোখ বুঝে বলে,
~ আপনাকে সত্যিই আমি চিনতে পারিই নি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। এই সবকিছুর জন্য দায়ী আমি। আমি যদি আপনাকে আগেই মেনে নিতাম তাহলে হয়তো এত কিছু হতো না। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন।
- একবার বলেছি তোমার কোন দোষ নেই। দোষ সেই লম্পটের যে তোমাকে মারতে চায়৷ আমি ওকে কখনো ছাড়বো না৷
~ তারপরও আপনার সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছি আমি। অনেক যা তা বলেছি।
- মাফ তো কবেই করে দিয়েছি আমি। সেগুলো আমি মনেই নেই নি।
~ সত্যি বলছেন?
- হ্যাঁ।
~ একটি কথা বলি? রাখবেন?
- একশোটি বলো। সব রাখবো৷
~ নাতাশা আপুর ইচ্ছা ছিল আমি যেন আপনাকে বিয়ে করি। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আমাকে বিয়ে করবেন? আমি চাই নাতাশা আপুর ইচ্ছাটি পূরণ করতে৷ অন্তত সে আমাদের একসাথে দেখে খুশি হবে৷
- তোমাকে বিয়ে করে নিজের করার জন্যই তো এত ছোটাছুটি। চলো কালই বিয়ে করে ফেলি৷ আমার মনে এখন সবসময় তোমাকে হারানো ভয় করে।
~ আমি রাজি। আর এভাবে বিয়ে ছাড়া আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে পাপও হবে৷
আরিয়ান না চেয়েও একটু হেসে দেয় তাসনুভার কথায়। এই খারাপ সময়ে তাসনুভাই ওর শেষ ভরসা। আরিয়ান চায় তাসনুভাকে খুব তাড়াতাড়ি একদম ওর করে নিতে৷ আরিয়ান নাতাশার শেষ ইচ্ছাটি অবশ্যই পূরণ করবে৷ ও তাসনুভার কপালে একটি চুমু দিয়ে বলে,
- তাহলে আমরা কালই বিয়ে করবো। আঙ্কেল আন্টিকে সকালে রওনা দিতে বলি৷ এখানে তোমার সাথে থাকলো। তাহলে তুমিও ভালো থাকবে৷
তাসনুভা খুব খুশি হয়ে যায়। ওর খুশি দেখে আরিয়ান একটু শান্তি পায়৷ তাসনুভাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে আরিয়ান ঘুমিয়ে পড়ে। আজ তাসনুভা আর বাধা দেয় নি। কারণ ওর মনেও ভয় ঢুকে আছে আরিয়ানকে হারানোর। তাসনুভা বুঝতে পেরে দুনিয়ার সবার কাছে আরিয়ান খারাপ হলেও কিন্তু ওর কাছের মানুষগুলোর কাছে ও অনেক ভালো। ও অনেক মহৎ। যেটি তাসনুভা অনেক পছন্দ করে। তাই আরিয়ানকে দ্রুত ওর স্বামী হিসেবে ও গ্রহণ করতে চায়। আর বিয়ে ছাড়া এভাবে আরিয়ানও থাকতে চায় না৷ কাল তাসনুভাকে বিয়ে করবে বলে আরিয়ান খুব এক্সাইটেড হয়ে আছে। ওর ভালবাসাকে ও একদম নিজের করে পাবে।
পরদিন সকালে,
আরিয়ান আগে আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। পাশে তাসনুভা এখনো ঘুমাচ্ছে। ওর ঘুমন্ত মুখখানা দেখে আরিয়ান একটু হলেও শান্তি খুঁজে পায়। একটু না অনেক। তবে তাসনুভার মুখের দিকে তাকালে ওর নাতাশার কথাও মনে পড়ে। আর সাথে সাথে মনটি ভীষণ খারাপ হয়ে যায়৷ তবে আরিয়ান চায় না আর মন খারাপ করতে৷ নাতাশার ইচ্ছাটি ও পূরণ করবেই। তাসনুভাকে ও আজই বিয়ে করবে। তাহলে হয়তো নাতাশা অনেক খুশি হবে দূর থেকে। আরিয়ান দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়। ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসে৷ টনি ৭/৮ জন বডিগার্ড নিয়ে ওর রুমের দরজার বাইরে পাহারা দিচ্ছিলো। আরিয়ানকে দেখে টনি বলে,
- স্যার গুড মর্নিং।
- গুড মর্নিং।
- স্যার কফি দিব?
- হুম দেও। টনি আমার সাথে আসো। আর তোমরা এখানে থাকো।
- ওকে স্যার।
আরিয়ান টনিকে নিয়ে হল রুমে আসে৷ টনি সার্ভেন্টকে বললে আরিয়ানের জন্য কফি নিয়ে আসে। টনি চামচ দিয়ে একটু খেয়ে কিছুক্ষণ পর আরিয়ানকে দেয়। আরিয়ান কফি নিতে নিতে বলে,
- আরে তোমাদের আমি বিশ্বাস করি।
- তাও স্যার।
- আচ্ছা যাই হোক, আজ একটি বিশেষ দিন৷ আজ তাসনুভাকে আমি বিয়ে করবো। তুমি সন্ধ্যায় বাড়িতে কাজী নিয়ে আসবে৷ আর আমার রুমটি সুন্দর করে সাজিয়ে দিও।
- ওকে স্যার। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই মিলে কাজ করবো।
- আচ্ছা দাঁড়াও তাসনুভার বাবা মাকে আগে রওনা দিতে বলি। ঢাকাতে আমাদের লোক আছে না তারা যেন ওনাদের নিয়ে আসে। অবশ্যই বুলেট প্রুফ গাড়িতে।
- ওকে স্যার আমি এখনি বলে দিচ্ছি।
- হুম বলো।
আরিয়ান তাসনুভার বাবাকে কল দেয়,
- আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
- অলাইকুম আসসালাম বাবা। কেমন আছো তোমরা?
- জি আঙ্কেল ভালো। তবে এই দুঃসময়েও একটি ভালো খবর দিতে চাই।
- কি বাবা বলো বলো।
- আঙ্কেল আর কিছুক্ষণ পর আমার লোকেরা আপনাদের নিতে যাবে৷ তাদের সাথে আমার এখানে চলে আসেন। আজ সন্ধ্যায় আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন৷
- কি! সত্যি বলছো বাবা?
- জি আঙ্কেল। আজ সন্ধ্যায়ই তাসনুভাকে বিয়ে করবো আমি৷
- ঠিক আছে বাবা আমরা দুজন রেডি হয়ে চলে আসছি।
- জি আসেন আসেন৷
আরিয়ান ফোন রাখলে পাশ থেকে টনি বলে উঠে,
- স্যার বলে দিয়েছি।
- গুড।
- স্যার একটি প্রশ্ন করি?
- হুম।
- স্যার এ সময় হঠাৎ করে বিয়েটা করছেন যে এভাবে? আমরা ভেবেছিলাম আপনার বিয়েটা অনেক বড়ো করে হবে৷
- তাসনুভাকে মারার জন্য কে যে উঠে পড়ে লেগেছে। এখন আমার সবসময় ভয় হয় ওকে হারানোর। তাই ওকে বিয়ে করে সবসময় আমার কাছে রাখতে চাই। আর নাতাশারও ইচ্ছা আমি তাসনুভাকে বিয়ে করি৷ তাই আর কি৷
- ওহ! তাহলে স্যার আপনি কোন চিন্তা করবেন না আমরা সুন্দর করে আপনার বিয়েটা দিব।
- হুম তোমরাই এখন আমার ভরসা। যাই হোক এবার আসল কথায় আসা যাক৷ কোন খবর পেয়েছো কি?
- জি স্যার। তবে আমাকে বলে নি৷ আশরাফ (ডিবি প্রধান) স্যার আপনাকে বলবে বলেছে৷
- ওকে আমি কল দিচ্ছি।
আরিয়ান আশরাফ সাহেবকে কল দেয়,
- হ্যালো মিস্টার আরিয়ান, কি অবস্থা আপনার এখন?
- জি সেইফ আছি। তা কিছু জানতে পেরেছেন?
- হ্যাঁ। যে শুটার গুলো গতকালকে অ্যাটাক করে ছিল তারা আসলে আপনার এক্স পার্টানার সিরাজ খানের লোক।
- কিহ! ও এত বড়ো সাহস পেলো কই?
- সেটিই ত ভাবছি। কিন্তু ও আপনার উপর এত ক্ষিপ্ত কেন?
- গতবছর আমার সাথে বিজনেসে কম্পিটিশন করতে গিয়ে বিশাল বড়ো লস খেয়েছে। তাই বলে এত জঘন্য কাজ ও করবে? আর ও এত লোক আর আর্মেসের টাকা পেল কই?
- কি বলবো মিস্টার আরিয়ান, শত্রুকে শেষ করতে এটি কিছুই না৷ তবে আপনি চিন্তা করবেন না৷ আমাদের স্পেশাল ফোর্স কাজ করছে। খুব শিগগিরই একটি ফাইনাল অ্যাকশনে যাবো আমরা।
- ধন্যবাদ। আমি অপেক্ষায় আছি।
- জি।
আরিয়ান ফোন রেখে দিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে যায়। পাশ থেকে টনি বলে উঠে,
- স্যার কিছু জানতে পারলেন?
- সিরাজ খান! ওর লোক নাকি গতকালকে আমাদের অ্যাটাক করেছিল।
- স্যার শুধু অর্ডার করেন, দেখেন ওর অবস্থা কি করি।
- হুম, আশরাফ সাহেবের ভরসায় বসা যাবে না৷ যা করার আমাদেরই করতে হবে৷ ওকে খুব সহজে মারলে হবে না। ও আমার নাতাশাকে মেরেছে। শোনো আমার কাছে একটি প্ল্যান আছে।
- জি স্যার বলেন।
আরিয়ান ওর প্ল্যানটি টনিকে বলে দেয়। টনি সে মোতাবেক কাজ শুরু করে। টনি চলে গেলে আরিয়ান বলে, সিরাজ খান অনেক বড়ো একটি ভুল করেছিস তুই। এতদিন আমার ভালো রূপটা দেখেছিস। এবার দেখবি আমি কতটা খারাপ হতে পারি। আরিয়ান তাসনুভার কাছে চলে যায়। রুমে ঢুকতেই দেখে তাসনুভা বসে বসে কান্না করছে। আরিয়ানকে দেখে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে তাসনুভা। আর অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
~ আমাকে একা ফেলে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? সেই কখন থেকে একা বসে আছি। যদি কেউ এসে আমাকে মেরে...
তাসনুভা কথা শেষ করার আগেই আরিয়ান ওর মিষ্টি ঠোঁটটি....
লিখেছেন: আবির
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন