সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০২২

গল্প: বাবা নামের বৃক্ষটি

সন্ধ্যার দিকে একটি ছেলেকে দেখলাম তার বাবার সাথে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। বের হয়ে আসার সময় শুনতে পেলাম সে তার বাবাকে অনেক ভাষাতে গালি দিতে দিতে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে ছেলেটি।

ওই ছেলেটি আমার জুনিয়র সম্ভবত ইন্টার পড়ুয়া হবে। আমি তখন ছেলেটিকে ডাক দিলাম।

"এই যে ছোটভাই এদিকে এসো একটু শুনো।"

তখনো তার রাগ কমেনি, তা ওর ঈর্ষান্বিত চোখ দুটি দেখেই আঁচ করতে পারলাম।

"কোনো সমস্যা হয়ছে কি? ভদ্রলোকটার সঙ্গে ওভাবে খারাপ আচরণ করে বেরিয়ে আসলে যে।"

ছেলেটি এবার বলেই ফেললো," কিসের ভদ্রলোক, উনি আস্ত বদমায়েশ একটা। আর সে হল আমার বাবা।"

"তো নিজের বাবাকে বদমায়েশ বলছো কেন?"

"তো আমি কি বলবো, শুধু জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। জন্মের পর সন্তানদের যদি চাহিদায় পূরণ না করতে পারে তাহলে কিসের বাবা সে?"

ছেলেটিকে একটু সাইডে নিয়ে গিয়ে দুইজনে বসলাম। তারপর বললাম," কেন কি এমন আবদার করেছিলে যে সেটি পূরণ করতে পারেনি?"

ছেলেটি এবার ক্ষুব্ধ হয়ে বললো," আপনি এসব জেনে কি করবেন, কোনো সমাধান দিতে পারবেন কি? তা তো পারবেন না।খামখা আমার সময় নষ্ট করবেন।"

"তা পারবো না,তারপরও শুনতে চাইছি তোমার আপত্তি না থাকলে বলতে পারো।"

ছেলেটি খানিকক্ষন চুপচাপ থাকার পর বললো, " কি আর বলবো পরিক্ষা শেষ,বাবা বলেছিলো পরিক্ষা শেষে আমাকে একটি বাইক কিনে দিবে এখন বলে কিনা,দিবে না। এমন মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার কি দরকার ছিলো, আমি বন্ধুমহলে কত কিছু বলে রেখেছি,তাঁদের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবো এখন?"

"সেটিও তো কথা,তা কিসের পরিক্ষা দিলে? "

"এস এস সি।"

"আচ্ছা তোমরা কয় ভাই-বোন? "

"তিন ভাই বোন, আর আমি সবার বড়।"

"তা তোমার বাবা কি করেন?"

"বাবার বাজারে একটি মুদির দোকান আছে।"

"আচ্ছা এতক্ষণ তো তোমার সম্পর্কে শোনালে এবার একটি গল্প শোনাই কেমন? কি শোনাবো...?"

"জি বলুন।"

"কখনো, "এতিম" শব্দটি শুনেছো?"

"হ্যা। কিন্তু কেন?"

"এতিম কাদেরকে বলে যানো?"

"হ্যা জানবো না কেন,যাদের বাবা-মা নেই তাঁদেরকে এতিম বলে।"

"আজকে তোমাকে তেমন একজন এতিমের গল্প শোনাবো,সময় আছে নিশ্চয়?"

"হ্যা বলুন।"

"একটি ছেলে, সে জন্মের ঠিক সাত মাস আগে তাঁর বাবাকে হারিয়ে ফেলে, আর তারপর জন্মের পর শুধু মায়ের ভালোবাসাতে বেড়ে উঠছিলো। কিন্তু মায়ের ভালোবাসাটিও তাঁর কপালে বেশিদিন সইলো না, ছেলেটির যখন ছয় বছর বয়স তখন ছেলেটির মায়ের আবার অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিলো ছেলের নানা বাড়ির লোকজন। ছোট ছেলে মা ছাড়া থাকবে কিভাবে,কিন্তু তারপরও মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে দু'জনকে আলাদা করে দিলো তার নানা বাড়ির লোকজন। আর তখন থেকেই সে নানা বাড়িতেই বড় হতে লাগলো।

এলাকার সবাই ছেলেটিকে ভালোবাসতো,তবে  সেটি আর দশজনের মত স্বাভাবিক নয়, আসলে ভালোবাসার আঁড়ালে করুনা নামক সিলমোহর জুড়ে দিছিলো তাঁরা। কারণ ঐযে ছেলেটি এতিম। সময়ের পালাক্রমে ছেলেটি ধিরেধিরে বড় হতে লাগলো,জগৎ সম্পর্কে ধিরে ধিরে বুঝতে শিখলো। আর সেই সাথে এটিও বুঝলো, "এতিম" শব্দটির মানে।

ছোট থাকতে লোকজন শব্দটি ব্যবহার করলে কিছু মনে হতো না, কিন্তু শব্দটির মানে বুঝতে পারার পর থেকে সে বুঝতে পারলো লোকজন তাকে ভালোবাসা নয় বরং নামের সাথে ঐ শব্দটি জুড়ে থাকাতে তাকে করুনা করে।

তখন থেকে সে ভিড়ভাট্টার ভিতরে যেতে লজ্জা পেতো।

জুম্মার নামাজ আর ঈদের নামাজে যখন সব বাবারা তাঁদের সন্তানদের হাত ধরাধরি করে মসজিদে নিয়ে যেতো তখন সে তাঁদের পাশে পাশে হাঁটতো, আর ভাবতো হয়তো তাঁর হাতটিও কেউ একজন ধরে নিয়ে যাবে।

কিন্তু না,তাকে একাই যেতে হয়েছে সবসময়।

কোনো উৎসবে যখন সবার মা খুব যত্নে তাঁদের সন্তানকে গোসল করানোর পর নিজ হাতে সাজগোছ করিয়ে দিতো,তখন সেও ভাবতো হয়তো এই বুঝি মা এসে তাকেও ওদের মত করে গোসল করিয়ে সাজগোছ করিয়ে দিবে, কিন্তু না সবকিছু তাকেই করতে হতো। সবাই খালি একটি কথা বলেই শান্তনা দিতো সবসময় বাবাটা জন্মের আগেই মারা গেলো আর মা থেকেও নেই।

ছেলেটি শুরুর দিকে কষ্ট পেলেও মেনে নিছিলো সবকিছু। আর এখনো তাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয়,"ঐ ছেলেটি এতিম," কথাটি।"

আসলে তোমাকে এতকিছু বলার একটিই কারণ, তুমি একটু আগে যেই জন্মদাতা বাবাকে বিশ্রি ভাষায় গালি দিতে দিতে বার হয়ে যাচ্ছিলে,তখন হয়তো তুমি পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির মুখটি দেখো নি,কিন্তু আমি দেখেছি।

তুমি চেয়েছো পরিক্ষার পর একটি বাইক,আর উনি হয়তো চেয়েছেন পরিক্ষার পর তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য ভালো কোনো কলেজে ভর্তি করানোর কথা। আসলে একটি কথা আছে না, আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য দিতে যানিনা।

কথাটি একদম ঠিক, যতোদিন মাথার উপর বাবা নামের গাছটি আছে ঠিক ততোদিন ছাঁয়ার কোনো অভাব হবেনা।

আর যেদিন গাছটি শুকিয়ে যাবে, সেদিন আর রোদের তাপ সহ্য করতে পারবে না। তুমি পরিবারের বড় ছেলে,তোমার পরে আরো দুজন তোমার ভাই-বোন আছে।

তাঁদের কথাও বাবা-মাকে ভাবতে হয়।

তোমার বাবার সামান্য একটি মুদির দোকান থেকে কি পরিমান রোজকার হয় তা হয়তো কখনো জানতে চাওনি, কারণ ওসব আমরা জেনে কি করবো,যখন যেটি আবদার করবো তখন সেটি পেলেই হলো।

পুরণ করার মানুষটি কোথা থেকে আনবে, কিভাবে আনবে সেটি তার দেখার বিষয়।

আর বললে না বন্ধুমহলে মুখ দেখাতে পারবে না, ওমন বন্ধুদের সাথে না চলায় ভালো।

এক সপ্তাহ না খেয়ে দেখো কোনো বন্ধু আসবে না খাওয়াতে, আর আসলেও দুদিন খুব বড় জোর চারদিন।

তারপর ঠিকি ছেড়ে দিবে।

দেখা-শোনা আর দায়িত্ব দুটো কথা একই শোনালেও দুটোর ভিতরে বিস্তর ফারাক বুঝলে।

বন্ধুমহল,প্রতিবেশিরা দেখা-শোনা পর্যন্তই ঠিক আছে,দায়িত্বের কথা উঠলেই পিছুটান দেয়।

আর বাবা সে তো দায়িত্বের আরেক নাম।

আর সেই দায়িত্ব জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বহন করে যায়। তাই বলছি কি ঠুনকো অভিমানে ওদের কষ্ট দিও না,মেনে নিতে নিতে একদিন যখন আর সয়তে না পেরে হারিয়ে যাবে,সেদিন আর হাজার আপসোস করলেও ফিরে আসবে না। এতিম আমরা সবাই,তবে নিজে যোগ্য না হয়ে এতিম হওয়াটা যে কত বড় কষ্টের তা তোমরা বুঝবে না।

বাসায় যাও, যেয়ে বাবার হাতটি ধরে ক্ষমা চেয়ে নিও।"

ছেলেটি এতক্ষণ সবকিছু শোনার পর বলল," আপনি এতক্ষণ যে ছেলেটির গল্প আমাকে শোনালেন সেই ছেলেটি কে?"

আমি তখন সামান্য হেসে বললাম," আমিই হলাম সেই অধম। এখন তুমি যাও, বাড়িতে ফিরে যাও। হয়তো তোমার পথ চেয়ে তোমার পরিবার অপেক্ষা করছে।"

রাইটার: আশিক আহম্মেদ

আরও:

কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং শিখবেন?

গল্প: বড় আপার বিয়ে

ভালো সিভি লেখার টিপস


বলতে পারেন গল্প সংগ্রহ করা আমাদের নেশা। আপনারা আপনাদের গল্প লিখে পাঠাতে পারেন। আমরা সকল লেখকদের সম্মান করি আর আমাদের সাইটের কোন গল্প নিয়ে কারো কোন অভিযোগ থাকলে অবশ্যই জানাবেন। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

- CEO of KaziSilo 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন