টাকাপয়সা সবকিছু ঠিকঠাক করেছি পিকনিকের জন্য এমন সময় আম্মা কাছে এসে বললেন,
"তোর পিকনিকে যাওয়ার দরকার নেই। আমার মনটা কেমন জানি করতেছে! দূরে কোথাও আমাকে ছাড়া একদিনও তো থাকিস নি আর কক্সবাজার গিয়ে কিভাবে থাকবি এতোটাদিন?"
আম্মার কথাগুলি শুনে আমি একটু রাগান্বিত স্বরে বললাম,
"আম্মা! এই শেষ মুহূর্তে এসে এসব কথা কিন্তু আমার মোটেও ভালো লাগছে না। প্রথম থেকেই তোমাদেরকে আমি এতো বার বলার পর শেষমেশ টাকাগুলি আমার হাতে দিলে। আমার সব বন্ধুরা যাবে! তুমি কেনো বুঝতে পারছো না? এখন আমি বড় হয়েছি, একটু বোঝার চেষ্টা করো। আর আমি থাকতে পারবো কি পারবো না সেটি আমি বুঝবো। তোমার এতো বুঝে কাজ নেই।"
আমার কথায় আম্মার নিরস মুখটি যেন আরো একটু নির্জীব হয়ে গেলো।
ভার্সিটির কয়েকজন বন্ধু মিলে আমরা একমাস আগে থেকেই মোটামুটি কক্সবাজারে ট্যুরের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু সমস্যা ছিল আমার বাসায়! স্কুল লাইফ থেকে এখন পর্যন্ত বহু পিকনিক নিজের বন্ধুদের করে আসতে দেখেছি। কিন্তু নিজের হাজারো আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও বাবা মায়ের জন্য কখনো যাওয়ার সুযোগ হয়নি। যখন সেসময় রাগ করে বসে থাকতাম তখন আম্মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন,
"রাস্তাঘাটে তোর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি কিভাবে থাকবো? বলতো! আরেকটু বড় হ, তখন তোকে আর কোনো বাঁধা দিবো না।"
তখন আম্মার এমন আবেগঘন কথা শুনে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার।
কিন্তু ভার্সিটির এই প্রথম পিকনিকে আমি অনেকটা তাদের কথার তোয়াক্কা না করেই পিকনিকে যাওয়ার জন্য সবকিছু রেডি করে ফেলেছি। যদিও আমার বাবা এসবের কিছুই জানেন না, তিনি যদি একবার জেনে ফেলেন তাহলে তো আর রক্ষে নেই। তাই আম্মার সাথে অনেকটা জেদ করেই টাকাগুলি আমি নিয়েছি।
কিছুক্ষণ বাদে বাদেই আম্মা আমার কাছে এসে বলছেন,
"বাবা! আমার মনটা কেমন যেন করছে! তোর পছন্দের খাসির মাংস আর খিচুড়ি রান্না করবো তবুও তুই যাইস না।"
শেষমেশ আমি অনেকটা উত্তেজিত স্বরেই আম্মুকে বললাম,
"এবার তুমি যত যাই বলো না কেন আমি যাবোই। তোমাদের কারনে আমি ঠিকমতো কিছু করতেও পারিনা। কই! আমার বন্ধুদেরও তো বাবা-মা আছে, নাকি? তারাতো তোমার মতো এতো আদিখ্যেতা দেখায় না। আমি এবার তোমার আর কোনো কথা শুনছি না।"
আমার কথা শুনে হয়তো আম্মা কিছুটা কষ্ট পেয়েছেন আমি সেটি তার মুখাবয়বেই বুঝতে পেরেছি। বাবা আম্মার শেষ বয়সের একমাত্র সন্তান হওয়াতে হয়তো আমার প্রতি তাদের আবেগ এবং ভালোবাসাটা একটু বেশিই বটে।
আমার বন্ধু জনিকে ফোন দিয়ে হাসিমুখে বললাম,
"দোস্ত টাকা তো রেডি করে ফেলেছি। কালকে কখন রওনা দিবি?"
আমার বন্ধু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"তোর বাপ মা এতো সহজে রাজি হয়ে গেলো? কিভাবে সম্ভব? তাদের আলালের ঘরের দুলালকে ট্যুরে যেতে দিচ্ছে, আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না।"
আমি হালকা হেসে বলি,
"এখন মজা করার মুডে নেই কখন রওনা দিবি সেটা বল!"
"কালকে সন্ধ্যার ট্রেনে উঠবো, তুই বিকালের দিকেই কমলাপুর চলে আসিস।"
আমি উৎফুল্ল মনে সম্মতি দিয়েই বন্ধুকে বিদায় জানালাম।
সকাল থেকে মায়ের শরীরটা ভালো নেই। দুপুর থেকে যখন বিকাল গড়ালো তখন শরীরের অবস্থা আরো নাজুক। বাবা ব্যবসায়িক কাজে অধিকাংশ সময়ই বাহিরে থাকেন তাই আম্মাকে নিয়ে আমিই হাসপাতালে যাই। কিন্তু আজকের দিনে হঠাৎ করে মায়ের অসুস্থ হওয়াতে মনের মধ্যে বেশ রাগ জমলো কেননা কিছুক্ষণ পরেই কমলাপুর যেতে হবে আমায়।
হাসপাতালে এসেছি আম্মাকে নিয়ে কিন্তু আমার মন পরে আছে কখন যাবো বন্ধুদের উদ্দেশ্যে? একপর্যায়ে আমার বন্ধু ফোন দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
"কিরে! তুই কি যাবিনা নাকি? তোর জন্য আমরা কিন্তু ট্রেন মিস করতে পারবো না।"
ওদের কথার প্রতিউত্তরে আমি কিছু বলার সাহসও পাচ্ছি না। কারণ এই মুহূর্তে আম্মাকে হাসপাতালে রেখে চলে যাবো যে তাতেও মন কেন যেন নিজেকেই ধিক্কার জানাচ্ছে বারংবার।
এবারও মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো না। হ্যাঁ! বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যেতে পারিনি। এজন্য রাতে না খেয়েই ঘুমিয়েছি অনেকটা আম্মার সাথে রাগ করেই।
সকালে আমার বন্ধু জনির আম্মুর কলে ঘুম ভাঙ্গলো। হঠাৎ এই অসময়ে তার ফোন পেয়ে কৌতূহলবসত রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে তিনি বলেন,
"মারুফ! তুমি কোথায়? জনিদের সাথে আছো?"
আমি অবাক হয়ে বলি,
"না আন্টি আমিতো যেতে পারিনি। কেনো কি হয়েছে?"
"জনিসহ ওর বন্ধুরা চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজারে বাসে যাওয়ার সময় সেই বাসটি অ্যাক্সিডেন্টে করেছে। ওদের নাকি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আমরাও যাচ্ছি এখন চট্টগ্রামে। তুমি বাবা না গিয়ে ভালোই করেছো। আল্লাহ তোমাকে বাঁচাইছে।" মাতৃস্নেহ ও ট্যুরে যাওয়ার গল্প।
আন্টির কথা শুনে মুহূর্তেই আমার হৃৎপিণ্ডে ধুক করে একটি প্রকম্পন অনুভূত হলো।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে টেবিলে উপস্থিত হতেই দেখি আম্মা আমার জন্য গরম গরম খিচুড়ি আর খাসির মাংস টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন এমনকি তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে এখন তিনি অসুস্থ। হয়তো আমার বন্ধুরা ভাগ্যের পরিহাসে এমন একটি বিপদের সম্মুখীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমার মা কিভাবে এমন বিপদ আগে থেকেই আঁচ করতে পারলেন? হয়তো আমাকে অতিশয় ভালোবাসার জন্যই কিংবা শেষ বয়সের একমাত্র সন্তান বলে ছেলের জন্য মনের মধ্যে পুষে রেখেছেন হাজারো আবেগ। ভাবছি, সত্যিই যদি আমার কিছু হতো তাহলে তিনি কেমন করতেন? শুধুই কি কান্না করতেন নাকি দুঃখে বারবার মূর্ছা যেতেন? এর উত্তরটি হয়তো আল্লাহ জানেন, আমার জানার সাধ্য হবেনা কখনো কোনোদিন।
লিখেছেন Misk Al Maruf
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন