আমার প্রথম চাকরি হওয়ার পর থেকেই চারদিক থেকে সবাই আমাকে কল করা শুরু করলো। বিশেষ করে আমার দাদি, ফুফুরা, বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার ছেলেমেয়েরা।
আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা,
ঘরে আম্মুর কাজকর্মের ঠুনকো বিষয়গুলো যখন নাকি সংঘাতে রূপ নিলো। তখনি দাদীর কঠোর সিদ্ধান্তে বাবা আম্মুকে ডিভোর্স দেয়।
আমার বাবার ও নাকি মত ছিলো আম্মুকে ছেড়ে দেওয়ার। তখন আমার বয়স পাঁচ বছর। আইনমতে কন্যাসন্তান মায়ের কাছে থাকবে। ভরণপোষণ বাবা বহন করবে। এটিই ফাইনাল হয়েছে।
শুরু হলো আম্মুর সাথে নানারবাড়িতে আমার জীবন যাপন। আম্মু একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি করতে লাগলো। আমার বাবা ভরনপোষণ দেয় বলতে দুই ঈদে কিছু টাকা আর জামা কাপড়। আম্মু তা নিয়ে কোন বাড়াবাড়িই করতোনা।
কারণ হিসেবে আম্মু বলতো,এই মেরুদণ্ডহীন লোকটির কন্ঠ শুনতেও রুচিতে বাঁধে। যে আম্মুর কথাকে বেদবাক্য মনে করে। আর স্ত্রীর কথাকে গ্রাহ্যই করেনা।
যে বিশ্বাস করে জীবনে সুখে শান্তিতে থাকতে হলে আম্মুর সন্তুষ্টির বিকল্প নেই। যে আম্মু একটু কাশি দিলেও অস্থির হয়ে যায়। আর স্ত্রীর গলা দিয়ে রক্ত বেরুলেও ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন মনে করেনা।
যে স্ত্রী কাপড়ের চেয়ে আম্মুর কাপড় বেশী দামী হওয়া জরুরী মনে করে। যে আম্মুর পছন্দের খাবার না চাইতেই হাজির করে। আর স্ত্রী শতবার বললেও কিছু এনে দেয়না। ভুলে যাওয়ার বাহানা দিয়েই খালাস।
আমি আম্মুর আদর যত্ন আর মামিদের অবহেলায় একটু একটু করে বড় হতে থাকি। আমাকে স্কুলে ভর্তি করানো হলো। আম্মু খুব চেয়েছিলেন বাবার গ্রামের স্কুলে আমাকে ভর্তি করানো হোক। কারণ নানাদের একান্নবর্তী পরিবার। অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চা। সারাদিন মারামারি লেগেই থাকে। আর বাবাদের একা বাড়ি। বাবার আর কোন ভাই নেই। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।
কিন্তু দাদী তা হতে দেয়নি। সবসময় শুনতাম দাদা দাদীরা নাতি নাতনিকে পেটের সন্তানের চেয়েও অধিক যত্ন করে। কিন্তু আমি একথা মানিনা। কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার হিংসুটে দাদী দুচোখেও আমাকে পছন্দ করেনা। অথচ সৎ মায়ের ঘরের আমার সৎ বোনকে দাদী নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসে।
এর কারণ হিসেবে আমার মনে হলো, আমার চেহারা সবার চেয়ে খারাপ। তাদের সবার চেহারা সুন্দর। তাই আমার মুখ দেখলেই দাদীর মুখে অমাবস্যার ঢল নামে। আরেকটি কারণ, বাবার ছেড়ে দেওয়া স্ত্রীর পেটে জন্ম নিয়েছি আমি। যাকে ঘৃণা করে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। তার পেটে ধরা সন্তানকে কেন ভালোবাসবে।
বাবা আমাকে দুই ঈদে বাড়ি নিয়ে যায় লোক পাঠিয়ে। তখন খাতির যত্ন অনেক করে। প্লেট থেকে মুরগীর কলিজা,বড় চিংড়ি আমার প্লেটে তুলে দেয়। গাছ থেকে পেয়ারা, লিচু পেড়ে দেয় চুপিচুপি। দোকান থেকে কাপ আইসক্রিম কিনে দেয়।
তাতেই আমার কলিজা দিগুণ হয়ে যায়। বুঝে নেই বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসে। ভুলে যাই আমার প্রতি দাদীর এক দরিয়া ঘৃণাকে। বাবার মায়া মমতায় কোন খাদ ছিলোনা। কিন্তু দুঃখ হতো বাবা তার মায়ের একমাত্র বাধ্য ছেলে। তার মা যার সম্পর্কে যেভাবে বোঝাতো, বাবা সেটিই বুঝে নিতো। তাই বাবাকে আমার ও মেরুদণ্ডহীন মনে হতো।
এক শীতের আগমনী সময়ে বাবা ঢাকায় গেলো প্রয়োজনে। তারপা আকস্মিক বাস চাপায় বাবা মরে গেলো। অথচ পুরো বাসের কারোই কিছু হলোনা। আমার বাবাই শুধু মারা গেলো। গভীর রাতে এ নির্মম সংবাদটি আম্মুর ফোনে কল দিয়ে অন্যকেউ জানায়। তারপর আমার মামা আমাকে নিয়ে যায় দাদার বাড়ি। আমি বাবার নিথর দেহখানির দিকে চেয়ে থাকি আর ভাবি এ জনমে বাবার বাড়িতে আমার বুঝি আর কোনদিন আসাই হবে না।
বাবা মারা যাওয়ার পর ও সেখানে মাঝে মাঝে যাই। তাও যাই বিপদে পড়ে। নানার পরিবারে যখন অশান্তি শুরু হয়, তখন আম্মু উপায়ন্তর না পেয়ে পাঠিয়ে দেয় কয়েকদিনের জন্য। নিজের দাদীর শত্রুর মতো আচরণ দেখেও থাকতে হয় অসহায় আমার বেহায়া সেজে।
আমি এলে দাদী কখনো ভুলেও জানতে চায়না আমি কেমন আছি। বরং সৎ মা আমাকে বেলায় বেলায় কেন ভাত দেয়, তা নিয়ে তাকেও কথা শোনায়। সৎ ভাইবোন কেন আমার কাছে আসে, খেলা করে,গল্প করে সেজন্য ওদেরকেও শাসায়।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমি বড় হতে থাকি। আর মন দিয়ে পড়াশোনা করি। ভালো ছাত্রী হওয়ার ভালো কলেজে উঠেই নানা বাড়ির আশেপাশের কিছু স্টুডেন্ট পেয়ে গেলাম। ওদেরকে পড়াই। মাস শেষে বেতন পেলে কিছু টাকা মামাতো ভাইবোনদের পিছনে খরচ করি। মামিরা খুশী। এখন আমাকে আগের চেয়ে বেশী সমীহ নজরে দেখে। বুঝতে পারলাম যোগ্যতার কদর সবাই করে। তেলা মাথায় তেল সবাই দিতে চায়। দাদার বাড়িতে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছি।
কলেজ পাস করে আমি এখন অনার্সের প্রায় শেষের দিকে। টিউশনি করে আর আম্মুর শিক্ষকতার টাকায় মোটামুটি মা মেয়ের বেশ চলে যায়। আম্মু আর দ্বিতীয় বিয়ে করেনি কেবলমাত্র আমার কথা ভেবেই।
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে পার্ট টাইম জব পেয়ে গেলাম। বেতন ও ভালো। অনার্স-মাস্টার্স এ পড়ার চাপ নেই স্কুল কলেজের মতো। তাই আর আপত্তি করলাম না চাকরির অফারটি পেতেই।
যে ফুফুরা কালে ভদ্রে কল দিতো। তারা এখন সপ্তাহ পার না হতেই কল দিয়ে ভালো মন্দ খবর নেয়। যে দাদীর চোখের বিষ আমি,তার আদিখ্যেতা দেখলে আমার সারা গা ঘিনঘিন করতে থাকে। গলায় দরদের সুর দেখলে বমি আসে। সৎ মায়ের কুশলাদি জিজ্ঞেস করা দেখলে হাসি আসে।
আমি শুধু একবার ভাবি,যখন আমার জীবনে দুঃসময় ছিলো, তখন এই নামধারী প্রিয়জনদের দরদ কোথায় ছিল। ভালো করে কখনোই একটু গল্পগুজব করেনি আমার সাথে। বুকে টেনে নেয়নি এরা পরম মমতায়।
আর আজ যখন আমার জীবনে সুসময়ের আগমনী বার্তা ধরা দিতে এলো রঙধনুর মতো। অমনি তাদের উপচে পড়া দরদ শুরু হয়ে গেলো। বিশেষ করে দাদীর। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে তিনি এখন শারীরিক, মানসিক,অর্থনৈতিকভাবে ধরাশায়ী নিয়তির করাতলে। রসিয়ে রসিয়ে আলাপ জুড়ে দেয়। আমি ব্যস্ততা দেখিয়ে কল রেখে দিই। আমাকে নাকি এখন দাদীর এখন দেখতে ইচ্ছে করে।
মনে মনে বলি, দাদী ভুলানো কথায় যে এখন আমার মন ভোলেনা। সময় যে কখন কার হয়ে ধরা দেয় এটি আগে থেকে কেউই বলতে পারেনা।
লেখিকা: রেহানা পুতুল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন