ছেলেটি খুব বড় হয়ে গেছে তো! তার মাঝে আগে কেমন একটি পিচ্চি পিচ্চি ভাব ছিল। এখন তার ছিঁটেফোঁটাও তার মধ্যে দেখা যায় না। বরং শক্ত-সমর্থ এক যুবক হয়েছে। কিন্তু তার মুখটা আজও সেই ভীষন মায়া মায়া।
তখন আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। ভার্সিটিতে এক বছরের সিনিয়র হয়ে গিয়েছি সেই ভাবে আমি তখন পুরা পাংখা। প্রথম বর্ষের স্টুডেন্টদের র্যাগ দেওয়ার জন্য আমরা তখন ছটফট করছি। যদিও র্যাগ দেওয়াটা খুব অনুচিত কাজ জানি, কিন্তু আমরা এটাকে ঠিক র্যাগ বলি না। জাস্ট বড়দের সঙ্গে ছোটদের পরিচিত হওয়া আর তাদের একটু চমকে দেওয়া এই আর কি! আমরাও তো এই সময়কে পার করেছি তাই ওরা বাদ যাবে কেন? ডিপার্টমেন্টের সামনে বসে আছি আমরা কয়েকজন। প্রথম বর্ষের রূপবতী একটি মেয়ে আর একটি চশমা পড়া গোবেচারা ছেলেকে আমরা র্যাগ দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলাম। ছেলেরা ছেলেদের র্যাগ দিবে আর মেয়েরা দেবে মেয়েদের, এটাই নিয়ম। কিন্তু আমরা তো নিয়ম মানি না।আমরা মেয়েটাকে অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলাম। ফরহাদ মেয়েটাকে একটি ছড়া বলতে বলেছিল আর রূপবতী কন্যার চোখ ছলছল করে উঠেছে তাই বেচারীকে তখন ছেড়ে দিলাম। আমাদের হাতে আটকা পড়ে গেল এই ছেলেটি। আমিই তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম ছেলেটাকে।
-নাম কি?
-প্রীতম।
-নামের আগে-পিছে কিছু নেই?শুধু প্রীতম?সার্টিফিকেটে তাই লেখা?
-না,না।সরি।প্রীতম মিত্র।
-মানে কি নামের?
-পূজার ফুল।
-বাহ! ফুল। আমাদের সামনে তাহলে একজন ফুল বসে আছে। কিন্তু ফুলের গন্ধ কোন নাই কেন? আর কি ফুল? গোলাপ, শিউলি নাকি?
-যে ফুল দিয়ে পূজা করা হয়। অনেক ফুলই হতে পারে।
-তা ফুলবাবু তোমার ওই চশমার পাওয়ার কত?
-মাইনাস সিক্স।
-চশমা ছাড়া কি অন্ধ?
-জি, প্রায়।
-চশমাটা আমাকে দিয়ে তুমি জনি মামার টং থেকে আমাদের সবার জন্য এক কাপ করে চা নিয়ে আসো তো।
-জী, চশমা ছাড়া আমি কিছু দেখি না। আমি এক কদমও হাঁটতে পারব না।
-একটা থাপ্পড় লাগাব। আমি তোমার বড় না? কথা বলার সময় আমাকে আপু বলা যায় না? বেয়াদব পোলাপান দিয়ে ডিপার্টমেন্ট ভরে যাচ্ছে। একদম সোজা করে দেব।
ধমকের চোটে প্রীতম নামের ছেলেটা তখন অন্ধের মত হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে টুকটুক করে রাস্তা দিয়ে হাঁটার ট্রাই করছে চশমা ছাড়া। ধুর!ভালো লাগছে না। এই গাধাটাকে ধরে চশমাটা দিয়ে দিলাম। র্যাগ পর্বের সেদিন সেখানেই সমাপ্তি ছিল। জনি মামার টঙে বসে আছি মনমরা ভাবে!বাসায় যাওয়ার জন্য আমার মনটা কেমন করছে, ক্লাসের জন্য যেতেও পারছি না। সকালের ক্লাসটাও আজ মিস হয়ে গেছে,ফরহাদ, নাদিয়া, নিশা, রাশেদ সবাই ক্লাসে। আমিই একা ক্লাস মিস করে গেছি, যদিও প্রক্সি পড়ে যাবে। চা' এর কাপ অনেকক্ষণ থেকে ধরেই আছি অথচ আমি একটি চুমুকও দেই নি। চা ঠান্ডা মেরে গেছে বোধ হয় ততক্ষনে।
-আপনার চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি প্রীতম।
-আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে না।
-তাহলে নিয়েছেন কেন শুধু শুধু?
-অভ্যাসের ঠেলায়। তারপর তোমার পরীক্ষার ডেট দিয়েছে নাকি?
-জি। দিল। আগামি ১২ নভেম্বর।
-তা প্রিপারেশন কেমন?
-যতটুকু খারাপ হওয়া দরকার।
-ক্লাস নাই তোমাদের এখন?
-জি হচ্ছে।
-ক্লাস মিস দিয়ে এখানে কি পিচ্চি?
-আপনারও তো ক্লাস ছিল এখন, তা আপনি কি করছেন? মুচকি হেসে প্রীতম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চাহনিতেই তার কেমন একটা ছেলেমানুষি কাজ করছে। আমিও হেসে বললাম "ক্লাসটা মিস হয়ে গেছে রে পিচ্চি।"
-আর আপনাকে দেখে আমি এখানে।
-মানে কি?
-জি কিছু না। আপনার নামটা কিন্তু ভয়ঙ্কর সুন্দর। অনিন্দিতা।আচ্ছা, আমি আজ যাই। আপনি ভালো থাকবেন। পিচ্চি চলে গেল।আমি তাকিয়ে দেখলাম।ছেলেটার মাথায় ছিট আছে বোধহয়। আমি একটি জিনিষ খেয়াল করেছি কখনো ও আমাকে আপু বা দিদি বলে না। অথচ নাদিয়া, নিশাকে বলে! কি অদ্ভুত! কার কাছ থেকে যেন আমার ফোন নাম্বার যোগাড় করে হথাৎ একদিন রাতে ফোন দিয়ে আমার কাছ থেকে পরীক্ষার সাজেশন চাইল, আমি তখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বলতে পারেন লুসিড ড্রিম। তো ঘুম থেকে উঠে তাকে সাজেশনটা দিলাম। নাম্বার কোথায় থেকে পেয়েছে জানতে চাওয়ায় জবাব না দিয়ে হুট করে সে একটি কবিতা বলল। সে নিজে নাকি লিখেছে।প্রীতম আর আমার দুইজনেরই বই পড়া আর মুভি দেখার চরম নেশা ছিল। বই আর মুভি শেয়ার করতে করতে আমাদের ভেতর কিভাবে জানি একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতাম, আর ঝগড়া করতাম। লেখালেখি করতাম আমরা দুইজনই। ও লিখত কবিতা আর আমি টুকটাক গল্প। মাথায় লেখা জট পাকিয়ে গেলেই ফোন দিতাম "ওই, পিচ্চি, আমার লেখা আটকে গেছে মাথায়। একটু ছাড়ায়ে দাও তো!" প্রীতম তখন গল্পের কাহিনীটা শুনত, কিভাবে আগালে ভালো হবে বলে দিত। নতুন কোন কবিতা লিখলে আমাকে ওর সবার আগে শোনানো লাগবেই লাগবে! আমার কোন গল্প ভালো না হলে তার ভুল ধরিয়ে দিয়ে একগাদা সমালোচনা করা, ওর রোমান্টিক কবিতা নিয়ে আমার হাসাহাসি করা, ওকে পিচ্চি বললে রাগে গাল লাল করে ফেলা এভাবেই দেখতে দেখতে প্রায় দুই বছর কেটে গেল।
-অনু, আমি কিন্তু তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তুমি বুঝতে পারো? প্রীতম যেদিন বলেছিল আমায় কথাগুলো আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। অবাক হই নি কারন জানতাম একদিন না একদিন ও আমাকে এটা বলবেই! আমি বুঝতাম আগে থেকেই, এড়াতে পারতাম হয়তো! কিন্তু এড়াই নি কারন আমি নিজেই নিজেকে ওর কাছ থেকে এড়াতে পারি নি। এই আবেগে ভরা পিচ্চিকে আমি বহু আগেই ভালোবেসে ফেলেছি, ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে, সমাজের কথা মাথায় না এনে, পরিবার-আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুদের কথা না ভেবে আমি আমার চেয়ে এক বছরের ছোট একটি ছেলেকে ভালোবাসেছি! আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি আমরা দুজনই জানতাম কিন্তু কি আর করা? দুজন দুজনকে এড়াতে পারলাম কই? বাসায় আসতে থাকা সব বিয়ের প্রাস্তাব আমি একে একে ফিরিয়ে দিতে লাগলাম। বাবা-মা কারন জিজ্ঞেস করে করে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। আমি বলতাম "আমি কখনো বিয়ে করবো না, প্লিজ মা আমাকে জোড় করো না। আমার স্কলারশিপ হয়ে গেছে। আমি আর দুই-তিন মাসের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া চলে যাব। এর মাঝে বিয়ে বিয়ে করে আমার মাথা দয়া করে খেয়ো না।" বাবা-মা কোন কারন বের করতে না পেরে চুপ হয়ে গেলেন।কারনটা আর কি হবে?পিচ্চি।আমি আর ও ঠিক করেছিলাম আমি আর ও কখনো বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে কিছু করবো না। আমাদেরকে ওনারা কখনো মেনে নেবেন না তাই আমরা দুজন এভাবেই দূর থেকে ভালোবেসে যাব। তারপর আমি অস্ট্রেলিয়া চলে গেলাম। পিচ্চি থাকল বাংলাদেশে।আমাদের স্কাইপে যোগাযোগ হত, ফোনে কথা হত। আমাদের ভালোবাসা কমে নি একটুও।
তিন বছর পর দেশে এসে বইমেলায় আমি আর পিচ্চি ঘুরছি। আমার একটি উপন্যাস আর পিচ্চির কবিতার বই এইবারের একুশের বইমেলায় বের হয়েছে। পিচ্চি অবশ্য আমার চেয়ে বড় হয়ে গেছে, ভীষণ বেশি বোঝে এখন। কিন্তু ও তো আমার সেই পিচ্চিই। আমরা ভালো আছি। দূর থেকেই একজন অন্যজনকে ভীষণ বেশি ভালোবেসে ভীষণ বেশি ভালো আছি।রাত আটটা বেজে যাচ্ছে। পিচ্চিটা আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।আমি ওর যাওয়া দেখছি। বাড়িতে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এখন মা'র হাতের ঝাল মুরগী ভুনা দিয়ে ভাত খাব, একপাশে আমার বাবা অন্য পাশে মা। ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি।
রাইটার: প্রাঞ্জলিকা গোমেজ
-
টিকা: লুসিড ড্রিম বলতে এমন এক প্রকার স্বপ্নকে বুঝায় যেখানে একজন মানুষ চাইলে স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন করতে পারেন। একজন লুসিড ড্রিমার তার স্বপ্নের মাঝেও জেগে থাকে এবং সে যে স্বপ্ন দেখছে তা বুঝতে পারে। আর স্বপ্ন দেখার সময় কোনো কিছু চিনে ফেলা হচ্ছে লুসিড ড্রিম এর প্রথম পর্যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন