বিয়ের পরের দিন সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে সবাইকে নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছি। একটু দূরে সোফায় বসে আমার কাজিন ননদ, দেবরেরা সবগুলো ভাইবোন একসাথে বসে নাস্তা করছে, আর বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলতেছে। হুট করে একজন দেবর বলে ওঠে
- নিশো ভাই নিশিকে পাগলের মতো ভালোবাসতো কতো মার না খেয়েছে এ ভালোবাসার জন্য। এখন কি জানি নাদিয়া ভাবিকে নিশির মতো ভালোবাসতে পারে কি-না??
দেবরের কথা শুনে আমি একদম হতভম্ব হয়ে যাই, ওখানে কি বলছে ওরা? নিশো ( আমার স্বামী) সে কি না অন্য কাউকে ভালোবাসতো তাও আবার পাগলের মতো??? তাহলে রাতে এতো এতো আদর, যত্ন এগুলি কি ছিল? আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। দেখতে শুনতে সুন্দর ছিলাম বলে লাইফে অনেক প্রোপজাল পেয়েছি। কিন্তু আমি কখনো কারোর সাথে সম্পর্কে জড়াইনি, শুধু মাত্র বিয়ে না হলে বরকে ঠকানো হবে বলে। আর এখন শুনছি উনি কাউকে ভালোবাসার জন্য মাইর পযর্ন্ত খেয়েছে।
সারাদিন মেহমান থাকায় আমার উনার সাথে আর কোন কথা হয়নি। সন্ধ্যার সময় অনেকে চলে যায়। তারপর আমি মাথা ব্যাথার বাহনায় রুমে শুয়ে থাকি। উনি আমার জন্য মাথা ব্যাথার ঔষধ আর কিছু হালকা খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।
এসে বলে
- নাদিয়া ওঠো হালকা কিছু খেয়ে ঔষধটা খেয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো। তুমার অনেকটা ভালো লাগবে।
আমি তখন শান্ত স্বরে বলি
- বিরক্ত করবেন না আমি এই মুহূর্তে কোন কিছুই খাবো না।
- ওকে তাহলে আমি তুমার মাথা ম্যাসাজ করে দিই। এভাবে শুয়ে থাকলে তো বেথা ভালো হয়ে যাবে না। হয়তো ঔষধ খেতে হবে, না হয় মাথা ব্যাথার মলন দিয়ে ম্যাসাজ করতে হবে।
আমি এবার একটু রেগে বলি
- এতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না, আপনি যেয়ে আপনার নিশিকে নিয়ে থাকুন। শুধু শুধু আমার লাইফটা শেষ করে দিলেন। এতো অভিনয় কি করে করতে পারেন আপনারা ছেলেরা। ভালোবাসেন একজনকে বিয়ে করেন অন্যজনকে। আপনাদের কি একটুও খারাপ লাগে না??
বলতে বলতে আমি কেঁদে দিই, আমি যখন অনেক রেগে থাকি তখন কথা বলতে গেলে কান্না চলে আসে।
তখনি উনি আমার কান্নার মাঝে আমাকে জোর করে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
- আমাকে তো কিছু বলার সুযোগ দাও , নিজের মতো করে সব কিছু ভাবলে তো হবে না। অপর পক্ষেরও কিছু বলার অধিকার রাখে।
আমি উনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলি,
- কি বলার আছে আপনার? আপনি ওই মেয়েটার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মাইর পযর্ন্ত খেয়েছেন।
উনি আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
- হুম ঠিক বলছো ওকে পাওয়ার জন্য আমি মাইর খেয়েছি। যে গাধাগুলা তোমাকে কথাগুলো বলছে ওরা এটা বলে নাই, ওর সাথে আমার আরও ৭ বছর আগে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। এখন ওকে আমার মনে পড়ে না কারণ একটাই ও একজন বেঈমান আর বেঈমানদের কখনো মনে রাখতে নেই। যতই ওদেরকে ভালোবেসে থাকি না কেনো।
এমন নয় যে ও আমাকে ছেড়ে দুনিয়া থেকে চলে গেছে,
এমন নয় যে ওর পরিবার ওকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।
এমন নয় যে আমার দিক থেকে কোন সমস্যা ছিলো ওকে বিয়ে করার।
একমাত্র আমাকে ছেড়েছে আমার থেকে ভালো কাউকে পেয়েছে বলে। যাকে পেয়েছে তার মতো করে আমি ওকে রাখতে পারব না বলে। কারণ ওর অনেক চাই অনেক, সবকিছু চাই শুধু ভালোবাসা পেলে তো আর হবে না। তাই তো ওর জন্য আমি আমার পড়ালেখা আনকমপ্লিট করে বিদেশে পাড়ি জমায় ভাবলাম অন্তত ওকে নিয়ে সুখে থাকতে পারবো। কিন্তু রিলেশনের আট বছর পর একদিন হঠাৎ আমার সাথে ঝগড়া লেগে গেলো। আমি ভাবলাম কয়েক ঘন্টা পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তিনদিন হয়ে যাওয়ার পরেও আমার কল রিসিভ করে নাই। চারদিনের দিন আমার এক বন্ধু আমাকে ওর কয়েকটা গায়ে হলুদের ছবি পাঠায়। আমি তো এগুলো দেখে একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। বিদেশের বাড়িতে কি করব না করব বুঝতে পারছিলাম না। কি-না করছি ওর জন্য বাবা-মার অজান্তে ওর জন্য টাকা পাঠাতাম। যেনো কোনো সমস্যা না হয়। দেশে থাকতে ওর বড় ভাইয়ের হাতে কতবার সে মাইর খাইসি শুধু ওর পিছনে ঘোরার জন্য। সবকিছুই এক নিমিষে শেষ করে অন্যজনের হয়ে গেলো। একবারও আমার কথা ভাবলো না। তার দু-এক মাসের মধ্যেই ও ইউএসএ চলে যায়।
তখন ওর এক কাজিনের কাছ থেকে আমি জানতে পারলাম ও ইচ্ছে করে এগুলো করছে যাতে ইউএসএের ছেলেটাকে বিয়ে করতে পারে। মনটা ভেঙ্গে গেলো।
নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতে থাকলাম তখন বাবা-মা ভাই বোন সবাই বোঝালো। কিন্তু আমি ওকে সহজে ভুলতে পারছিলাম না। তারপর আরো সাতটা বছর কেটে গেলো। তোমার ছবি দেখার আগে ভাবতাম ভালোবাসা একবার হয়, কিন্তু না তোমাকে দেখার পর আবারও আমি প্রেমে পড়েছি, আবারও কাউকে ভালোবাসার সাহস করেছি।
হয়তো টিনেজার বয়সে যে পাগলামি গুলো সবাইর সামনে করতাম তা করতে পারবো না। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক অনেক ভালোবাসা আদান-প্রদান করবো। আর সে তুমি পুরো কথা না যেনে এভাবে অভিমান করে আছো।
আসলে আমারই ভুল হয়েছে মায়ের কথা না শুনে তোমাকে সব কথা বিয়ের আগে বলে দেওয়া উচিত ছিলো। তাহলে আজকে এদিন আসতো না।
এতোক্ষণ উনার কথা শুনে আমার চোখ ভিজে ওঠে। আহারে মানুষটা ভুল মানুষকে ভালোবেসে এমনিতে শেষ হয়ে গেছে। তার উপর আমি কতো কথাই না বললাম।
আমি উনাr দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি,
- ঠিক আছে আর কখনো না বুঝে আমি অভিমান করবো না। তবে আমার শর্ত আছে স্বর্ণ, গয়না, টাকা, দামি দামি পোশাক এগুলো না দিলেও হবে। শুধু ভালোবাসা, আদার, যত্ন করলেই আমি আর কোন অভিযোগ করবো না আপনার বিরুদ্ধে।
উনি তখন কিছু না বলে মুচকি হেসে আমাকে উনার বুকের ভেতর চেপে ধরে।
byজিনাত আফরোজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন