প্রতিদিন সন্ধ্যা রাত ১০টা বাজলেই কাজীবাড়ির বুড়িটার ক্যাটক্যাটে গলাটা শোনা যাওয়াটা এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বুড়োটাও কম যায় না, প্রতিদিন একই ভুল করবেই করবে।প্রতিটাদিন মশারী টাঙ্গানো ছাড়াই ঘুমিয়ে পরবে। বুড়োটা হয়তো বয়সের দোষে ভুলে যায়।আর নয়তো বুড়োটা বোধহয় ভুলটা করতেই ভালবাসে। কিন্তু বুড়োটা ভাল করেই বুঝে ওই ভুলের মাঝেই অনেক মমতা মাখানো সমাধান লুকিয়ে আছে।এজন্যই হয়তো অপেক্ষা করে বুড়িটা রাগে গজগজ করতে করতে কখন তার মশারিটা টাঙ্গিয়ে দেবে। আর এটাই বোধহয় সঠিক।নাহলে বুড়োটা গত ৬০ বছর ধরে একই ভুলে করে যাবে কেন।
এই যে দুইজন বুড়ো-বুড়ির গল্প বললাম, তারা হচ্ছেন আমার দাদা-দাদি। দাদার বয়স ৮৮ পেরিয়েছে,আর দাদির বয়স সবে ৭৮ পেরিয়েছে! আল্লাহর রহমতে তারা দুজনেই ভাল আছেন। আজকে ওনাদেরই গল্প বলব।আমি বড় নাতি হিসেবে ওনাদের কাছে সবসময়ই স্পেশাল আদর পাই।আর আমিও ওনাদের সাথে যথেষ্ট ফ্রী।ছোটবেলা থেকেই ওনাদের কোলেপিঠে বড় হয়েছি বলেই ওনাদের টোনাটুনির সম্পর্কটা সেই ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি।বড় হবার সাথে যখন যৌবনের রসায়ন যখন মাথায় ঢুকতে শুরু করেছে,তখনই অনুভব করতে শুরু করেছি ওনাদের অমিয় ভালবাসা,আশ্চর্য বোঝাপড়ার সুবাসটা।কখনো ওনাদের মুখে,কখনো আমার বাবা,ফুফুদের মুখে ওনাদের গল্প শুনেছি।আজকাল হয়তো ভালবাসার ধরন,রঙ,অভিরুচি পাল্টিয়েছে কিন্তু তারপরও ওনাদের ভালবাসার কাহিনী শুনলে আজকালকার ভালবাসাটাগুলোকে ছেলেখেলা বলেই মনে হবে।
দাদাকে দেখলেই যে কেউ বুঝবে এই লোক যুবক বয়সে অনেক হ্যান্ডসাম আর ফর্সা ছিলেন।দাদার বোনের কলকাতার এক কম্বাইন্ড কলেজে দাদা ছিলেন মেয়েদের কাছে রীতিমত হাটথ্রব।এই বুড়ো বয়সেও তার নিস্পাপ হাসিটা একটা গোমড়া মনকে নিমিশেই ভাল করে দেবার জন্য যথেষ্ট।আর সেই তুলনায় আমার দাদী যেমন কালো,তেমনি রগচটা স্বভাবের।আমি অবাক হয়ে ভাবতাম আমার দাদাভাই কি করে এই কালো মহিলাটাকে পছন্দ করলেন।একদিন কৌতূহল সামলাতে না পেরে দাদাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম।দাদা মুচকি হেসে যে উত্তর দিলেন তা শুনে পুরা টাসকি খেয়ে গেলাম।দাদা বললেন...’দাদাভাই,তুমি যদি আমার চোখগুলো নিয়ে তোমার দাদীকে দেখতে,তাহলে বুঝতে তোমার দাদী কতো সুন্দরী’ দাদীর ক্যাটক্যাটে কথাগুলোর মাঝেও যে মায়ামিশ্রিত আছে সেটা আমিও টের পেতাম।দাদাকে একদিন চেপে ধরলাম ওনাদের প্রথম পরিচয়ের গল্প বলতে।
চৈত্রের কোন একটা দুপুরে আমার দাদা ভাই ফিরছিলেন ১০ মাইল দুরের কলেজ থেকে। কাজীবাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় তার খুব পিপাসা পেল।বাধ্য হয়ে কাজীবাড়ির পুকুরের দিকে রওয়ানা দিলেন।তখনকার দিনে পুকুরের পানিই সুপেয় ছিল।ঘাটের কাছাকাছি এসে দেখলেন একটা মেয়ে ঘাট থেকে উঠে আসছে।মেয়েটা হয়তো গোছল করছিল এই ভেবে উনি লজ্জায় নিচের দিকে রইলেন।মেয়েটা হয়তো বুঝতে পেরেছিল দাদা অনেক পিপাসার্ত।তাই কোমর থেকে কলসি নামিয়ে মালসায় পানি নিয়ে দাদাকে পানি দিল।লজ্জাবনত দাদা মেয়েটার ডাক শুনে চোখ তুলে তাকাল।এর পর যা দেখল তা দাদা গত ৬৬ বছরেও ভুলতে পারেনি।মেয়েটার চোখগুলো ঠিকযেন হাতে আঁকা,পানরাঙ্গানো ঠোট আর গাল দুটোয় যেন একমুঠো অভিমান ঘাপটি মেরে বসে আছে এবং গালের টোলটা সেই অভিমানটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।সদ্য পার ভাঙ্গা হলুদ শাড়ি পরা শ্যামলবরন মেয়েটার ভেজা চুলের খোঁপার ছবিটাই যেন দাদা এতদিন মনে একে রেখেছিলেন।বিস্মিত নয়নে দাদা তাকিয়ে দেখছিলেন মেয়েটির খোঁপা খুলে ভেজা চুল ঝারা।
সেদিনই দাদা ঠিক করলেন, এই মেয়েটির সাথেই বাকি জীবনটা কাটাবেন। আর এজন্যই হয়তো কাজীবাড়ির সামনে গেলে শ্যামল বরন মেয়েটাকে না দেখলে তার যেন তৃপ্তিটা মিটতো না। কিছুদিনপর লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে নিজের পছন্দের কথা বললেন। আমার দাদার বাবা ছিলেন খুব দাম্ভিক ও একগুঁয়ে টাইপের লোক। তিনি কাজীবাড়ির লোকের সাথে সম্বন্ধ করতে চাইলেন না। আমার দাদাভাই রাগে ও দুঃখে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা। বরং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্য জায়গায় বিয়ে আয়োজন করলেন।বাধ্য হয়ে দাদা বাড়ি থেকে পালালেন। মুষল ধারের বৃষ্টির মাঝেই রাতের অন্ধকারে ওই মেয়েটার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। মেয়েটার জানালা খুঁজতে গিয়ে বাসার পাশে যে মুরগীর খোয়ারটা আছে সেটা খেয়াল করলেন না। সেজন্যই পিছলা খেয়ে খোঁয়াড়ের চালের উপর পরলেন। দাদাকে চমকে দিয়ে একযোগে সবগুলি মোরগ একসাথে ডেকে উঠলো। মুরগির আওয়াজ শুনে বাড়ির পাহারাদার জেগে গেলো।যথারীতি বাড়ির সবাই চোর ভেবে দাদাকে পাকড়াও করলেন। সেদিন মেয়েটার বাবা দয়াপরবশ না হলে দাদার থানা-হাজত হয়ে যেত। মুরগির খোঁয়াড়ের কাঁদায় মেকআপ হয়ে যাওয়া দাদাকে মেয়েটা চিনতে ভুল করল না। দাদার মুখে সব শুনে মেয়েটার বাবা দাদার বাবাকে খবর দিলেন।দাদার বাবা মান-সম্মান হারানোর ভয়ে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন।
দাদার বাবা মানসম্মানের ভয়ে রাজি হলেও কাজীবাড়ির মেয়েকে নিজের পুত্রবধু হিসেবে মেনে নিতে চাইলেন না। দাদার মা আমার দাদীকে অনেক আদর করতেন। তিনি তার স্বামীকে অনেকভাবে মেনেজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।দাদার বাবা প্রায়ই হুমকি দিতেন সম্পত্তির ভাগ দেবেন না বলে।তার বিভিন্ন আঁতে ঘা দেয়া কথা শুনে একদিন দাদা ভীষণ খেপে গেলেন। তিনি তার বাবার সম্পত্তির নিকুচি করে নিজের জমানো মাত্র ২৯৫ টাকা সহ দাদীকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। প্রচণ্ড জেদি আর কোনদিন বাড়িতে ফেরেননি,নিজের বাবার সম্পত্তি্রও ভাগ নেননি। মাঝে মাঝে লোক পাঠিয়ে মাকে নিয়ে যেতেন। দাদাভাই এখন কুমিল্লা শহরেই ৩টা বাড়ির মালিক। বাড়ি থেকে বের হবার পরের ৭ বছরের কথা জিজ্ঞেস করলে দাদা সেই কষ্টের দিনগুলোর কথা খুব আগ্রহের সাথে বলেন। চাকরীর খোজে পায়ের জুতার সুকতলাটাও ছিঁড়ে গিয়েছিল।শেষে নিজের জমানো শেষ কটা টাকা দিয়ে ব্যবসায় নেমে পরলেন।সেই সময় দাদী তাকে পুরো সমর্থন দিয়ে গেছেন। কোনদিন দাদাকে নিজের কোনকিছুর জন্য আবদার করেননি।বরঞ্চ একটা সময় কাঁথা সিলিয়ে সংসারে খরচ মেটাতেন। দেশ বিভাগের কিছুদিন পর চালের দামটা বেশি বেড়ে গিয়েছিল। দাদা বাসায় ফিরে ভাতের টেবিলে দাদীকে ডাকলে দাদী প্রায়ই বলতেন তিনি খিদে পাওয়ায় তিনি আগে খেয়ে নিয়েছেন। একদিন দাদা টের পেলেন যে দাদী না খেয়েই খেয়ে নেবার কথা বলছেন। দাদা কখনই দুপুরে বাইরে খেতেন না। দাদির রান্না আর দাদির হাতের পাখার বাতাস না পেলে যেন তার ভাত হজম হতো না।
আমার বড় চাচা জন্ম নেবার ৩ মাস আগেই দাদা দোকান বন্ধ করে দেন। অসুস্থ দাদীকে ওইসময় কোন কষ্টই করতে দেননি। বাচ্চা হবার দুই তিন দিন আগে দাদি পেটের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। কোন কিছুতেই ব্যথা কমানো যাচ্ছিল না।নামাজে অনিয়মিত,সিগারেটে আসক্ত দাদা সেদিন ওয়াদা করলেন আর কোনদিন নামাজ কাজা করবেননা,সিগারেট খাবেননা।দাদা তার ওয়াদা পুরোটাই রেখেছিলেন।দাদাকে রোমান্টিক মনে হলেও দাদি সবসময় নিজেকে আড়াল থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু তার রোমান্সটা ঠিকই বেরিয়ে পরে।দাদা পান খাওয়া লাল ঠোঁট দেখতে পছন্দ করেন বলে দাদী আজ ৮০ বছর বয়সেও পান খাওয়া ছাড়েননি। এখন দাদীকে এটা বললেই দাদী একবারে লজ্জায় একেবারে কুঁচকে যান।আমরা নাতিরা অবশ্য দাদিকে লজ্জা দিতে ছাড়ি না।দাদা মাঝে মাঝে বুকের ব্যথা উঠলে দাদি নিজে দাদাকে জিহবার নিচে স্প্রে করিয়ে দেন, তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তখন আমরা চুপিচুপি দাদির পিছনে হাজির হয়ে দাদির চমকে দিয়ে বলি...দাদি দিতে থাকো, আমরা কিছু দেখি নাই।দাদির লজ্জাটা তখন চোখেমুখে ফুটে উঠে।
ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখে তাদের দাম্পত্য জীবনের ৬১ বছর পূর্ণ হবে। এখনও প্রতিটা বিকালে মুন্সিবাড়ির সামনে হেটে গেলে দেখা যাবে দুটো বেতের মোড়ায় দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পাশাপাশি তজবিহ হাতে খুনসুটি করেই যাচ্ছে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হবে বৃদ্ধাটা বৃদ্ধটাকে বকেই যাচ্ছে।কিন্তু বৃদ্ধের মুখের দিকে আপনার সেই ধারনা পালটে যাবে। কেননা বৃদ্ধ তখন মুগ্ধ নয়নে বৃদ্ধার বকার সুধা পান করেই যাচ্ছে।তাদেরকে দেখলেই হবে,কেমন যেন অদ্ভুত মানিয়ে গেছে তারা। তাদের দেখলে মনে হবে,ভালবাসার সৃষ্টিই হয়েছে ওদের একসুত্রে বাঁধার জন্য। আমরা হয়তো আধুনিক প্রজন্মে জন্মেছি,কিন্তু ভালবাসার সংজ্ঞাকে আমরা বদলে দিতে পারিনি। এক ছাঁদের নিচে থেকেও ভালবাসাকে হাতড়ে ফিরি। ৩ বছরের প্রেম করার পর ৩ মাসও বিয়ে টিকে না। অথচ ওনাদের সময়ে বিয়ের আগে কেউ কাউকে চিনতেনও না। বয়সের সাথে সাথে রুপের বিনাশ ঘটলেও দুজনের মাঝে সত্যিকারের ভালবাসা বিনাশ কখনই ঘটে না।
দাদা-দাদীর বাড়ির ঠিক পাশেই আমার রুমটা। প্রতিদিন বিকালে আমার দুপুরের ঘুমটা ভাঙ্গে দাদীর জন্য দাদার পানদানিতে পান ছেঁচার টিং টিং শব্দে। শব্দটা হয়তো কিছুটা বিদঘুটে, কিন্তু শব্দটায় কেমন যেন ভালবাসা মিশে আছে।ভাদ্র আসতে বেশি দেরী নেই। এবার ঠিক করেছি এই ‘ওল্ড কাপল’ দের মেরেজ ডে টা বেশ আয়োজন করে পালন করবো। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দাঁতহীন মাড়ির হাসিটা দেখার লোভ সামলাই কি করে।
by Mahmud hasan সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন