দীর্ঘ ১৫ বছরের সংসার ভেঙ্গে আজ আমায় মুক্তি দেওয়া হলো। বয়স ১৫ তে পা রাখতে না রাখতেই আমাকে সংসারের জালে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। মা বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না, তার জন্য আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব সামলাতে না পেরে ১৮ বছরের বড় এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছিল।
শ্বশুরবাড়ি যেয়ে কিছু আমি বুঝছিলাম না বরং এত লোকজন দেখে আমি প্রচুর ভয় পেয়েছিলাম। বিয়ের রাতের পর ভোর চারটায় সময় আমাকে গালিগালাজ করে ডেকে দেন আমার শাশুড়ি আম্মা। উনার কথাগুলো গায়ে লাগত, আমার কলিজা ছিঁড়ে যেত। কোন কাজে একটু ভুল দেখলে বড় বড় অপমান করতেন। শুধু তাই নয় আমার মা বাবাকে টানতেন। আমি সেদিন কান্না করে আমার স্বামীকে সব কষ্টের কথা বলেছিলাম।
সে তো শুনেনি বরং আমাকে ধমক দিয়েছিল। তার থেকে আমি কোন সময় একটুও সাপোর্ট পায় নি। এই অবস্থা দেখে সামান্য একটু ভুলের জন্য আমার গায়ে হাত তুলেছিল আমার শাশুড়ি। আর আমার দেবর, ননদ সহ বাকি ছোট বড়রা তখন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
আর আমি তখন স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
সে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে শুধু খাচ্ছিল। দম বন্ধ করে শুধু সবকিছু হজম করছিলাম।
তার এক বছর পর আমি গর্ভবতী হযই। আমার কোলে আসে ফুটফুটে একটি মেয়ে সন্তান। তখন আমি মুচকি হাসছিলাম। কিন্তু আমার স্বামী ও শাশুড়ি আমার মেয়ে কে মেনে নেয় নি। এমনিতেই তখন আমি দূর্বল ছিলাম সেই মুহূর্তেও আমাকে ঠাটিয়ে চড় মারেন আমার স্বামী। আমি অবাক হলাম কিন্তু পরে সহ্য করেছিলাম। আসলে ভয় পেতাম ওদের প্রচুর। আস্তে আস্তে আমার মেয়ে বড় হতে লাগল। তার নাম রেখেছি নোভা। আমার বাচ্চা সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল। নোভা যখন ওর কাজিন দের সাথে খেলতে চাইতো তারা নাকি ওকে মেরে সরিয়ে দিত। তারপর নোভা কান্না করতে করতে আমাকে সব বলত তখন আমি তাকে বলতাম, 'আমি আছি না? আমি তোমার সাথে খেলব।' সে খুব খুশি হয়ে যেত।
এরপর আমি উনিশ বছর বয়সে মা হওয়ার আবারো সুখ পাই। তবে ভয় হচ্ছিল এই বাচ্চা যদি মেয়ে হয়! আমার শাশুড়ি ও স্বামী আমার সন্তান কে মেরে ফেলবে। তারা মেয়ে চায় না তারা ছেলে চায়, মেয়ের জাতি নাকি গর্ধব জাতি! কিন্তু আমি মেয়ের মা হলাম আবার। আমার খুশি লাগল। কিন্তু রেগে গেলেন আমার শাশুড়ি। শশুরবাড়িতে এক প্রকার যুদ্ধ করতে লাগলাম আমার দুই মেয়ে কে নিয়ে। আমি বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
কষ্ট করে এখানে থাকতে লাগলাম। আমার ছোট মেয়েটার নাম রাখলাম স্পৃহা। আমার স্বামী এসে আমাকে জবাব দিয়ে দিলেন, আমার মেয়ের কোন খরচ নিবেন না।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি মূর্খ ছিলাম বিয়ের পর পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছিল কিন্তু আমি চাইনা আমার মেয়েরা আমার মত মূর্খ হোক। ননদের ছেলে মেয়ের থেকে লুকিয়ে বই নিয়ে পড়াতাম তাদের সাথে আমিও পড়তাম। তাদের স্কুলেও ভর্তি করিয়েছি। দেখতে দেখতে নোভা ১৫ বছর ও স্পৃহা ১২ বছর বয়স হয়ে গেল। হথাৎ একদিন নিচ থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। তখন ওদের রুমে রেখে আমি নিচে গিয়েছিলাম। আমার বর সাহেব আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলেন যে, তিনি আমার সাথে আর থাকতে চান না, তালাক দিতে চান আমাকে।
আমি তখন তার পায়ে পড়েছিলাম তিনি যেন আমাকে তালাক না দেয়। কিন্তু শুনেননি তিনি। আমার শাশুড়ি আমার চুলের মুঠি ধরার সাথে সাথে আমার মেয়ে নোভা এসে ধাক্কা মারল দাদি কে। চেঁচিয়ে গর্জে উঠল ও। স্পৃহাও এসে তার বোনের সাথে তাল মিলালো। নোভা আমায় বলল, আমি যেন তালাকটা নিয়ে নিই এই নরকে সে আমাকে আর দেখতে চায় না। আমি শুধু হতভম্ব ছিলাম। তারপর এক পর্যায়ে তালাক হলো মেয়ে দুটো কে বেরিয়ে গেলাম। আমি ভাই ও বোনদের বাসায় গেলাম আশ্রয় নেওয়ার জন্য। আমার ভাই বিরক্ত হলেও আশ্রয় দিয়েছে। তারপর মাসের পর মাস যেতে লাগল। আমার ভাই একদিন এসে বলল, আমি যেন বাকি বোনদের কাছে আশ্রয় নিই। সেখানে কান্নাকাটি করে জোর করে আশ্রয় নিলাম।
আমার লজ্জা লাগতে লাগলো নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হতে লাগল। নোভা সবকিছু দেখছিল আমার কাছে এসে বলল, সে নাকি একটি পার্লারে জব নিয়েছে। সে নিজের ও স্পৃহার স্কুলের খরচ নিবে। আমাদের দিন এভাবে যেতে লাগল স্পৃহাও একদিন এসে বলল, সেও নাকি একটি মার্কেটে জব নিয়েছে নিজের খরচ নিজে নিবে। তাদের আমি বাধা দিলাম না। মাস শেষে দুই হাজার টাকা দুই বোনে আমার হাতে গুজে দিল। ভাই ও এখন আর যেতে বলছেন না। আমাদের সব দিয়ে ঠিকঠাক চলছিল আমিও ভাইয়ের ব্যবসায় ছোট পদে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে এক লোকের সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হয়। তারপর বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু আমি রাজি হলাম না কারন আমার এখনো দুই মেয়ে অবিবাহিত। ফাহাদ আর জোর করল না।
দুই বছর পর নোভা আসলো সে মিনতি করে বলে, সে নাকি বিদেশ যাবে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাবে। আমি ভাই ও ফাহাদ কে এসব জানালাম।
আমার ভাই প্রথমত রাজি ছিল না 'মেয়ে মানুষ বিদেশ গিয়ে কি করবে? এখানে তার বিয়ে করে সংসার করা ভালো' - ভাই বলল। ফাহাদ সাথে সাথেই রাজি হয়ে গিয়েছিল নোভার চঞ্চলতা ভাব দেখে। আর নোভা তার মামা কে কোনমতে রাজি করাল। আর্থিক দিক দিয়ে ফাহাদ ও জসিম (আমার ভাই) সাহায্য করেছে। তারপর একদিন নোভা চলে গেল আমাকে রেখে। এরপর অনেক বছর কেটে গেল আমার বিয়ে হলো ফাহাদের সাথে। এখন আর কোন কিছু আগের মত নেই সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। নোভা হয়ে গেল কানাডার এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইকোলজি টিচার। স্পৃহা লন্ডন থেকে ডাক্তারি পাস করেছে। আর আমি ফাহাদের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় থাকছি। ডিসেম্বর মাস আসলে আমার মেয়ে দুটো আমার কাছে চলে আসে এবং ফেব্রুয়ারি আসলে তারা ফিরে যায়। অতীতের কথা ভাবলেও অবাক লাগে। আমি কিন্তু একটা কথা বিশ্বাস করি, 'শত আঁধারের পরেও কিন্তু এক মুঠো সুখের আলো ঠিকই আসে।'
[ হোস্টেলের এক আপুর মুখ থেকে শুনে লেখা এই গল্প। ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন